আত্মবিস্মৃত বাঙালি ভুলে গেছে আজকের দিনের গুরুত্ব: রজত ভরদ্বাজ মুখার্জী

রজত ভরদ্বাজ মুখার্জী
আমাদের ভারত, ২০ জুন: আজ সেই ঐতিহাসিক ২০শে জুন, যে দিনটিকে আমরা অত্যন্ত কৃতজ্ঞচিত্তে পশ্চিমবঙ্গ দিবস হিসেবে উজ্জাপন করে থাকি। কিন্ত পশ্চিমবঙ্গ দিবস পালনের উদ্দেশ্য বা এই বিশেষ দিনটির তাৎপর্য সম্পর্কে আমরা অনেকেই হয়তো ঠিকঠাক অবহিত নই। কারণ পূর্বতন কংগ্ৰেস, বাম বা বর্তমানের তৃণমূল সরকার সুকৌশলে আমাদের এই ইতিহাস জানতে দেয়নি। প্রকৃত অর্থে হিন্দু বাঙালীর হোমল্যান্ড পশ্চিমবঙ্গ সৃষ্টির ইতিহাস আমাদের স্কুল কলেজের কোনও পর্যায়ের পাঠ্যক্রমেই রীতিমত ইচ্ছাকৃত ভাবে লিপিবদ্ধ করা হয়নি। বাম কংগ্রেসের মনে সবসময় একটা ভীতি কাজ করত যে পশ্চিমবঙ্গ সৃষ্টির প্রকৃত ইতিহাস সামনে এলে তাদের রাজনৈতিক অস্তিত্বের মারাত্মক একটা সংকট দেখা দিতে পারে।

বৃটিশ শাসকদের লেজুড়বৃত্তি করা যেসকল তল্পিবাহক নেতৃবর্গ দেশভাগ সমর্থন করেছিলেন, সমগ্র বাংলা নব নির্মীয়মান পাকিস্তানকে উপঢৌকন হিসেবে দেওয়ার জন্যে স্বতঃপ্রবৃত্ত তদ্বির করেছিলেন, তাদের বিরুদ্ধে সম্মুখ সমরে গিয়ে হিন্দু বাঙালীদের জন্য একখণ্ড হোমল্যান্ড ছিনিয়ে এনেছিলেন অকুতোভয় শ্যামাপ্রসাদ। একাগ্রতা, জেদ, দায়বদ্ধতা ও অমিতবিক্রমের সামূহিক পরাকাষ্ঠা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ওই হিংস্র ইসলামিক আগ্রাসনের মুখের গ্রাস কেড়ে নিয়ে প্রমাণ করেছিলেন যে ইচ্ছে থাকলে যে কোনও অসাধ্য সাধন সম্ভব।

একজন পরাক্রমী বঙ্গতনয় জীবন বাজি রেখে হিন্দু বাঙালীদের জন্য পশ্চিমবঙ্গকে ছিনিয়ে আনলেন, অথচ তাঁর পরবর্তী প্রজন্ম আজও তাঁকে তাঁর প্রাপ্য সম্মান থেকে বঞ্চিত করে রেখেছে, যা চরম অনুতাপের বিষয়। একজন সিংহপুরুষ পশ্চিমবঙ্গ নামক রাজ্যটির স্রষ্টা অথচ আত্মবিস্মৃত বাঙালি আজও তাঁর প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধাশীল নয়, এটা অকৃতজ্ঞতা নয় তো কি? আমরা, বাঙালিরা অধিকাংশই এই মহামানবের কীর্তি সম্পর্কে অবগত নই যা আমাদের নীতি নৈতিকতার স্খলনকেই প্রতিভাত করে। এই মানসিক দৈন্যতা, মননশক্তির অবক্ষয়ই আজ জাতি হিসেবে আমাদের সর্বস্তরে পশ্চাদবর্তী করে তুলেছে, যা আশঙ্কার জন্ম দেয়। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, যে নীতি নৈতিকতার স্খলন, মানবতার পতন যে কোনও জাতির অধঃপতনকে ত্বরান্বিত করে। অতএব জাতিগতভাবে আজ আমাদের আত্ম বিশ্লেষণের সময় এসেছে। এতদস্বত্ত্বেও আজও যদি আমরা দিবানিদ্রায় শায়িত থাকি তাহলে হিন্দু বাঙালীর জাত্যাভিমানের পাশাপাশি জাতিসত্ত্বাও যে অস্তিত্বের সঙ্কটের মুখোমুখি দাঁড়াবে সে কথা বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য।

প্রসঙ্গে প্রত্যাবর্তন করি। আসুন একনজরে দেখে নেওয়া যাক পশ্চিমবঙ্গ সৃষ্টির ইতিবৃত্ত ও সেটির সাপেক্ষে ভারতকেশরী শ্যামাপ্রসাদের অবদান।

১৯৪৭ সালের গোড়ার দিকে ক্ষমতার লোভে আক্রান্ত বৃটিশ শাসকদের পদলেহনকারী কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ স্বীকার করে নিলেন বৃটিশ শাসকের প্রস্তাবিত ভারত ভাগের সিদ্ধান্ত। এখানে মাউন্ট ব্যাটেনের দূরদর্শী কূটনৈতিক চক্রান্ত ও ক্ষমতালোভী জিন্নার প্রবল ইচ্ছাশক্তি বৃটিশদের মনোরথ পূরণে ভীষণভাবে সহায়ক হয়েছিল। অগ্রপশ্চাত বিবেচনা না করেই তদানীন্তন কংগ্ৰেসী নেতৃবৃন্দ হয়ে উঠেছিলেন বৃটিশ শাসক দলের ইয়েসম্যান, যে কারণে চতুর বৃটিশ শাসকদের অভীষ্ট চরিতার্থে উল্লেখযোগ্য কোনওরকম বেগ পেতে হয়নি।

সে সময় অবিভক্ত বাংলার মোট জনসংখ্যার ৫৫% ছিল মুসলিম ও অবশিষ্ট ৪৫% হিন্দু। মুসলিম সমাজের চিরাচরিত রীতি অনুসরণ করেই মুসলিম লীগ দাবি তুলল, যে গোটা বাংলাই পাকিস্তানকে দিতে হবে, যেহেতু সংখ্যাধিক্য তখন মুসলিমদের পক্ষে। এই দাবি গৃহীত হলে অসমও বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত এবং কালক্রমে সেটাও চলে যেত পাকিস্তানের মানচিত্রে। কিন্তু মুসলিম লিগের এই চক্রান্ত বিফল হল, বাধ সাধলেন ভারত কেশরী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় স্বয়ং। শ্যামাপ্রসাদবাবুই একমাত্র ব্যক্তিত্ব, যিনি তাঁর বিশাল রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার বলে অনুধাবন করতে পেরেছিলেন যে ইসলামী পাকিস্তান কখনো হিন্দুদের জন্য বসবাসযোগ্য তো হবেই না বরঞ্চ কালের আবহে তা পরিণত হয়ে উঠবে বসবাসের অযোগ্য এক নরককুন্ড। সেই দূরদর্শিতা থেকেই তিনি দাবি করলেন, ভারত ভাগ করলে বাংলাকেও ভাগ করে বাংলার হিন্দুপ্রধান অঞ্চলগুলি নিয়ে একটা ‘পশ্চিমবঙ্গ’ সৃষ্টি করতে হবে, যা হবে হিন্দুপ্রধান ভারতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গরাজ্য।

সেই অর্থে পশ্চিমবঙ্গ সৃষ্টির ভগীরথ বা কান্ডারী কিন্ত শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, যাকে সঙ্কীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির অভিপ্রায়ে চক্রান্ত করে অকালমৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল। দেশের শত্রু কংগ্রেসের নির্লজ্জতার এখানেই শেষ নয়, হত্যার পাশাপাশি ইতিহাসের পাতা থেকে চিরতরে মুছে ফেলতে সদা সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেছে তদানীন্তন বাম–কংগ্রেসী দেশবিরোধী শক্তির একাংশ।

যাইহোক একেবারে রনংদেহী মনোভাব নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ সৃষ্টির দাবি নিয়ে প্রচার করার জন্য শ্যামাপ্রসাদ চষে বেড়ালেন সমগ্র বঙ্গ এবং বলাই বাহুল্য যে হিন্দুদের স্বার্থ রক্ষার্থে তাঁর এই মহান কর্মযজ্ঞে পেয়ে গেলেন অনেকেরই নিঃশর্ত সমর্থন, যা তাঁকে মানসিকভাবে অনেকটাই বলীয়ান করেছিল। অনস্বীকার্য যে তাঁর এই লড়াইয়ে প্রত্যাশিত ভাবেই সমর্থন পেয়েছিলেন কিছু কংগ্রেসী নেতৃত্বের যাদের মধ্যে নিখাদ দেশপ্রেম ছিল। সেই সময়কার একাধিক বাঙালি হিন্দু মনীষীরা, যেমন সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, যদুনাথ সরকার, রমেশচন্দ্র মজুমদার প্রমূখ বিদ্বজনগণ অকুন্ঠ সমর্থন করলেন শ্যামাপ্রসাদ ও তাঁর হিন্দুপ্রধান বাঙালি হোমল্যান্ড সৃষ্টির দাবিকে। এই বিপুল জন সমর্থনের জেরেই বঙ্গীয় আইনসভা একরকম বাধ্য হল বাংলা ভাগ করার প্রস্তাব পাশ করতে। সে দিনটা ছিল ২০শে জুন ১৯৪৭।

শ্যামাপ্রসাদের অদম্য জেদ ও নিরলস প্রয়াসে সেদিন পশ্চিমবঙ্গ সৃষ্টি হয়েছিল বলে আমরা বাঙালি হিন্দুরা নিজেদের ভূমি পেয়েছিলাম, যার ফলশ্রুতি স্বরূপ আমরা আজ সগর্বে নিজেদের ভারতীয় বলে দাবি করতে পারছি। অন্যথায় আজ আমরা ইসলামী রাষ্ট্রে সংখ্যালঘুর তকমা নিয়ে পরাধীনতার নির্মম শৃঙ্খলে আবদ্ধ থাকতে বাধ্য হতাম।

বঙ্গ বিভাজন হল এবং তা হল দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতেই। শ্যামাপ্রসাদের আশঙ্কাকে সত্য প্রমাণিত করেই পূর্ব পাকিস্তান (অধুনা বাংলাদেশ) থেকে একে একে এদেশে আসতে শুরু করলেন নির্যাতনের শিকার হওয়া হিন্দুরা। ভূমিচ্যুত হতে থাকলেন অহিন্দু ভূমিদস্যুদের নির্মম নিষ্ঠুর আগ্রাসনে। নারীর সম্ভ্রম রক্ষা হয়ে পড়ল কার্যত অসম্ভব। লাঞ্ছনা, ধর্ষণ সহ বিভিন্ন ভাবে বিকৃত যৌন লালসার শিকার হতে শুরু করলেন হিন্দু বাড়ির মা বোনেরা। আক্ষেপের বিষয় এই যে পূর্ববঙ্গ থেকে রাতের অন্ধকারে পালিয়ে এসে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নেওয়া সাম্যবাদের স্বঘোষিত ঠিকাদার আত্মবিস্মৃত বাঙালি সমাজ এখানে এসে আবার সাম্যবাদের বুলি আউরানো শুরু করেছে যার ফলস্বরূপ আজ আবারও একবার এই পশ্চিমবঙ্গের বুকে হিন্দুদের “নিজভূমে পরবাসী” হওয়ার উপক্রম।

২০২১ নির্বাচন পরবর্তী একটার পর একটা ঘটে চলা হিন্দু নিপীড়নের সংবাদ আজ আর কারো অজানা নয়। সামান্য পারিতোষিকের বিনিময়ে মেরুদন্ড বন্ধক রাখা বিকৃত এবং বিক্রীত মিডিয়া সে সমস্ত সংবাদ পরিবেশন না করলেও সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে কিছুই আজকাল গোপন থাকে না।

তবুও আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ যে শ্যামাপ্রসাদের আত্মবলিদানকে কিছুতেই বিফলে যেতে দেব না, বুক দিয়ে আগলে রাখব আমরা আমাদের এই হোমল্যান্ডকে।

“এ লড়াই সেই সে লড়াই, সকল লড়াই ঘুচিয়ে দেবার
এ লড়াই বহু দিনের বাকির হিসেব চুকিয়ে দেবার।
এ লড়াই আঁধার চিরে, আলোর তোরণ পরশ করার
এ লড়াই তোমার আমার এ লড়াই সর্বহারার।”

আজকের এই দিনটিতে সমগ্র পশ্চিমবঙ্গ বাসীর পক্ষ থেকে মহাপুরুষ শ্যামাপ্রসাদের চরণে দন্ডবৎ প্রণতি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *