
ডা. রঘুপতি সারেঙ্গী
কোচবিহার, ১২ নভেম্বর:
“অসতো মা সদ্গময়
তমসো মা জ্যেতির্গময়
মৃত্যোর্মা অমৃতম্ গময়
অবিরাবীর্ম এধি।।”
উপনিষদ্ এর ঋষি’র আপাত দুর্বোধ্য এই আবেদন কে সরল-প্রাঞ্জল বাংলা ভাষায় তুলে ধরে কবিগুরু তাঁর নৈবেদ্য কাব্যে লিখলেনঃ
“………..আমি জেনেছি তাঁহারে,
মহান্ত পুরুষ যিনি আঁধারের পারে
জ্যোতির্ময়। তাঁরে জেনে, তাঁর পানে চাহি
মৃত্যুরে লঙ্ঘিত পারো, অন্য পথ নাহি।”
সংস্কৃতের ‘তমস্’ শব্দ থেকে বাংলা তমসা শব্দ এসেছে, যা’র অর্থ ঘোর-রাত্রি।
তাহলে উপনিষদ্ চাইলো, ঘোর তমস্ থেকে জ্যোতি’র পথে যাত্রা করতে। আর আমাদের ঋষি-তূল্য কবি আরও এক ধাপ এগিয়ে আমাদের নিশ্চিত করলেন যে,
ঘন ঘুট-ঘুটে অন্ধকার রাজ্যের পরেই জ্যোতির্ময়ী দেবীর সেই দিব্য-ধাম। চিন্ময় রাজ্য। আবার ইংরেজিতে ‘God’ শব্দটির ধাতুগত অর্থ (etimological meaning) “জোতির্ময় বা জ্যোতি বিচ্ছূরণকারী”।
ঠিক এইখানেই প্রশ্ন জাগে, তবে ঘন কৃষ্ণ-চতুর্দশী তিথিতে মায়ের আগমন এর কারনটি কী এখানেই সুপ্ত আকারে প্রোথিত?
প্রতীকিএই অন্ধকার আসলে কে? উত্তরঃ জীবের অজ্ঞানতা। যতক্ষন পর্যন্ত জীব তার এই অজ্ঞতাকে বুঝে, মুছে, সরিয়ে, এগোতে চাইবে না, একে আঁকড়েই বাঁচতে চাইবে ততক্ষণ ঈশ্বর রাজ্যে (পড়ুন, কালী’র ধামে) তার প্রবেশের কোনো অধিকারই নেই। আমাদের সব ধরনের দুঃখের কারন যে একটাই, তা হোল অজ্ঞানতা।
” অজ্ঞানেন জ্ঞানম্ আবৃতম্ তেন মুহ্যন্তি যন্তবঃ”–গীতা’র উদ্ঘোষ।
তাহলে, প্রতীকি এই “চতুর্দশী’র অন্ধকার” আসলে অজ্ঞানতা,
যা’র স্বরূপ মিথ্যা, মায়া, মোহ,
অহংকার, প্রতারণা ইত্যাদি।
দেবীর স্বরূপ আগেই আমরা জেনে গেছি। দেবীর চারিদিকে জমে থাকা অন্ধকারের আসল রহস্যও একটু বোঝা গেল। এবার একটু ভাবা যাক মায়ের আগমন ক্ষণটাকে নিয়ে।
মা যে আমাদের সাক্ষাৎ যোগমায়া কি না!
একটা কথা সুধী, পাঠক মাত্রেই জানেন,” Object lies better against it’s contrust”.
অর্থাৎ কিনা, রাত আছে বলেই দিনের স্পষ্টতা, কালো ক্যানভাসেই সাদা’র ঔজ্জ্বল্য। ঠিক সেই ভাবে, মসিকৃষ্ণ চতূর্দশী তিথি’র অজ্ঞানতার মাঝে আর শ্মশানের নিঃশব্দতায় প্রকটিত হন কালরাত্রি, মহারাত্রি, মোহরাত্রি স্বরূপিনী মা শ্যামা। “কালরাত্রির্মহারাত্রির্মোহরাত্রিশ্চ দারুণা” ( ১ম অধ্যায়, চন্ডী)।
তাহলে, অমাবস্যার ঘন অন্ধকারে করূণাময়ী মায়ের আগমনের উদ্দেশ্য একটাই–”জ্ঞানম্ জাগ্রতঃ”
(শিব সূত্র)।
মা যে আমাদের জ্ঞান এবং বৈরাগ্যের–ই সাক্ষাত স্বরূপ। শ্রীশ্রী চন্ডীতে এই দর্শনের স্পষ্টতা লক্ষনীয়। দেখুন, চন্ড-মুন্ড, রক্তবীজ এবং শুম্ভ-নিশুম্ভ নামের প্রবল পরাক্রমশালী দানব কূলকে হত্যা করার বহু পূর্বেই ‘ধূম্রলোচন’ দৈত্যকে বধ করেছেন দেবী। মনে হয়, শিক্ষিত মানবকুলের কাছে তিনি এই বার্তা দিতে চাইছেন যে, দৃষ্টির সামনে থেকে যতক্ষন ধোঁয়ার (মায়ার/অজ্ঞানতার) আবরণ না সরবে ততক্ষণ তিনি “আধারের পারে” চির অধরাই থেকে যাবেন। কলি’র জীব তাঁকে বছরে বছরে মাটি দিয়ে বানাবে, জবা দিয়ে পূজবে, ফল-খিচুড়ী খাওয়াবে, রাত-জেগে
আনন্দ-ফূর্তি মেরে পান-খাওয়া সেরে ভোর হোতে না হোতে …
“আবার এসো মা” বলে, নদীর জলে ছুঁড়ে ফেলবে, কিন্তু জানতে পারবে না কালী আসলে কে! সত্যি-সত্যিই এটা বড়ো বেদনার।