রঘুপতি সারেঙ্গী
আমাদের ভারত, ১৩ জানুয়ারি: অধিকাংশ জীবই কথা বলে। ঠোঁট-মুখ-জিহ্বা-তালু-কন্ঠের সুচারু শিল্পকলায় সৃষ্ট হয় শব্দ। স্থিরকরা অর্থ-যুক্ত শব্দের সফল বুননে জন্ম নেয় ভাষা। আর তা কেবল মানুষের মধ্যেই হবে এমন কোনো কথা নেই। তা ব্যাঙের সাথে ব্যাঙের হতে পারে, ব্যাঙ্গমা’র সাথে ব্যাঙ্গমী’র হতে পারে আবার বানর এর সাথে আর এক বণ্য বানরেরও হতে পারে। সে ভাষা আপনার বোধগম্য হতেও পারে, নাও হতে পারে। এক মাছের ভাষা অন্য মাছ বুঝতে পারলেই হল। এটাই হল কথ্য ভাষা…. যার উদ্ভব প্রথম।
বহুকাল পরে, সীমাবদ্ধ কিছু জ্যামিতিক রেখা’র সাহায্যে এই শব্দগুলির “সূত্রে মণি গনাইব” রূপ
দেওয়ার নাম লেখ্য ভাষা।
ভাষাতেই ভেসে ওঠে মনের ভাব। জগদীশ চন্দ্র বসু(মতান্তরে, মার্কনি) কে কুর্ণিশ জানিয়ে যাঁরা আবেগে বলে ওঠেন…… ” দূরকে করিলে নিকট বন্ধু” এনড্রয়েড মোবাইল সেট বাজারে আসার পরে এখন সেই তাঁরা কী বলবেন, শুনি! কোনো সুক্ষ্মতম বৈজ্ঞানিক সাফল্যকে বিন্দুমাত্র ছোটো না করে নিজের ভ্রষ্ট-মেধা কে প্রশ্ন করি, বিষয়টি কী সত্যি ঠিক ?
মনে করুন তো, আপনার হাতে আই-ফোন এর দামি সেট আর কানের কাছে ফিলিপস্ এর দামি রেডিও আছে কিন্তু কারুর গলায় কোনো ভাষা নেই। কী হোত সেদিন, ভাবতে পারেন ? অথচ একটা মোবাইলের প্রতি আমরা যতোটা যত্নশীল ঠিক ততটাই উদাসীন ভাষা প্রয়োগের বেলায়।
এদিকে,আমাদের মূল্যবোধ হীনতায় ভুগতে ভুগতে ভাষা এখন তার ‘সর্বনাশা’ রূপ পেয়েছে।
‘বচন’ বর্তমানে দূষণ সৃষ্টি করে চলেছে।
এক সময়ের মিষ্টি কথার ফুলঝুরী হঠাৎ “চাড়াম্ চাড়াম্” করতে শুরু করলো কেন? “কুহু-কুহু” থেকে মিষ্টতা টুকু সরিয়ে নিলেই তো তা “কা-কা” হয়ে যায় তাই না? ভোট এর কাড়া-নাকড়ায় একটি কাঠি পড়লে তো কথাই নেই। বয়স-সম্পর্ক-সামাজিকতাকে তুড়ি মেরে অ-সংস্কৃত শব্দের চয়নে, মিথ্যা আর অর্ধ-সত্যের বাক্যবাণে, প্রতিপক্ষকে প্রকাশ্যে যিনি যতো বিদ্ধ করতে পারেন তিনিই আসলে ততো বড়ো নেতা।
একটু ঠান্ডা মাথায় ভাবি আসুন।
যাঁরা এমন করছেন, যাঁদের সমালোচনা করতে বসেছি আজ আমরা…… হয় তাঁরা বলতে আমরা নিজেরাই নতুবা আমার কাকা বা আপনার ভাইই তো, নাকি ! ভোট আসবে, ভোট যাবে। আজ যে তৃণমূল কাল সে ভাজপা। আজের ভাজপা কাল কোনো বাম দলে নাম লেখাবে। পাঁচটা বছরের জন্য এটাই স্বাভাবিক নিয়ম। কিন্তু আমাদের সেই ৫০০০ বছরের সনাতন সংস্কৃতি….. তাকেই বা ভুলি কী করে? আজকের এই দুনিয়ায় চারিদিকে জল-দূষণ, বায়ু-দূষণ,শব্দ-দূষণ এর তালিকাতে আর কিছু সংযোজন নাই বা করলাম আমরা!
শ্রীমৎভগবদ্ গীতা জানাচ্ছেনঃ
অনুদ্বেগকরং বাক্যং সত্যং প্রিয়হিতঞ্চ যৎ।
স্বাধ্যায়াভ্যসনং চৈব বাঙ্ ময়ং তপ উচ্যতে।।
………. শাস্ত্রের নীতিকথা জেনে
যা সত্য,যা প্রিয় ও হিতকর এবং সর্বোপরি যা শোনালে কারুর কোনো মানসিক উদ্বেগ তৈরি হবে না…… এমন কথাই বলা উচিৎ। কারণ, মহাভারত এ মহামতি বিদুরের উক্তি……অপ্রিয়স্য চ অসত্যস্য বক্তা শ্রোতা চ দুর্লভঃ।