একসময়ের নীলকুঠি গোদাপিয়াশাল এম জি এম স্কুলের বাড়িটিকে হেরিটেজ ঘোষণার দাবি

পার্থ খাঁড়া, মেদিনীপুর, ২১ নভেম্বর: নীলকর সাহেবদের কাছারি বাড়ি। সেই কাছারিবাড়িতে চলে এখন স্কুল। সেই স্কুল চত্বর সম্পূর্ণ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শান্তিনিকেতনের আদলে পরিবেশ। এই কাছাড়ি বাড়িটিকে সরকারিভাবে সংরক্ষণ করার আবেদন এলাকাবাসী, স্কুল পড়ুয়া থেকে শিক্ষকদের।

গোদাপিয়াশাল এম জি এম স্কুলের ৭৫ বছর পেরিয়ে ৭৬এ পা। এক সময় এই স্কুল চত্তর ছিল নীলকর সাহেবদের কাছারি বাড়ি। আজও কিছু নিদর্শন প্রমান করে এই স্কুল বাড়ি কতটা ঐতিহ্যবাহী। বিদ্যালয় শুরু হয় গাছতলায়। শান্তিনিকেতনে প্রকৃতির সঙ্গে ছাত্রদের একাত্ম করতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গাছতলায় পড়ানো শুরু করেছিলেন। সেই স্বাদ এই বিদ্যালয়ের শুরুতে চালু হয়। এখনো রয়েগেছে সেই প্রাচীন ঐতিহ্য। বিদ্যালয়ের অফিস ঘরটি এখনো আকর্ষণীয়। ইংরেজ আমলে সাহেবদের থাকার জন্যে বা অফিস হিসেবে যে সকল ঘরগুলি তাঁরা তৈরি করেছিলেন তারমধ্যে এটি একটি।

নীলকর সাহেবদের বাগানবাড়ি তথা কাছারি বাড়ি থেকে এলাকার নজরদারি চলতো। গরিব মানুষকে নীল চাষে বাধ্য করতো এই নীলকর সাহেবরা। অবাধ্য হলে চলতো চাবুক। সেই সাথে নজরদারি থাকতো রানির গড়ের দিকে। এভাবে কাছারি বাড়িকে ঘিরে একটি শক্ত ঘাটিতে পরিণত হয়। বৃহত্তর এলাকা জুড়ে ছিল এই কাছারি বাড়ি ও বাগানবাড়ি। বিদ্যালয়ের চৌহদ্দি ছাড়িরে আজও তার সাক্ষ্য বহন করে।

নীল পাকানোর চুল্লি সহ ভগ্নপ্রায় কিছু কুঠি, ঘোড়াশালের সাথে সাথে হাতিশালছিল এই বিদ্যালয়ের চৌহদ্দির মধ্যে। এলাকাবাসির মুখে শোনা যায়, বহু নিদর্শন আজ ধ্বংস হয়ে গেছে। শুধু অক্ষত রয়েগেছে একটি বিশালাকার বাড়ি। এখানে এখন বিদ্যালয়ের অফিসঘর। প্রায় ১৮০০ শতকে এই বাগানবাড়ির মধ্যে কয়েকটি প্রাচীন বটবৃক্ষ বিদ্যালয়ের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে। সেই সাথে রয়েছে কয়েক হাজার গাছ। জঙ্গল এলাকার মধ্যে এই কাছারি বাড়ি গঠনের উদ্দেশ্য একাটাই ছিল, ইংরেজদের গোপন বৈঠক ও নজরদারি।

যাই হোক না কেন এখনকার বিদ্যালয়টি ২২ একর জায়গার উপর অবস্থিত। ১৯৪৮ সালে তৎকালীন নীলকুঠির ম্যানেজার এইচ বি গ্রাহাম ফ্লেমিং এলাকাবাসীর ছেলেমেদের পড়াশোনার বিষয়ে সদয় হয়ে আগে গড়ে ওঠা বিদ্যালয়টিকে সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণিতে উন্নিত করেছিলেন। কারন এখানকার ছেলেদের হেঁটে যেতে হতো মেদিনীপুরের কেশপুর ব্লকের আনন্দপুরে। দশ কিলোমিটার দূরে, এভাবে দিন বদলের পালা শুরু হয়। ১৯৬৬ সালে কাছারি বাড়িতে বিদ্যালয় কে স্থানান্তর করা হয়। আগে গোদাপিয়াশাল এ পঠন পাঠন হতো, যা বর্তমানে মেয়েদের স্কুল।

১৯৬৮ সালে তৎকালীন প্রধান শিক্ষক বিমলাপ্রসন্ন মজুমদার শান্তিনিকেতনের আদলে ক্লাস শুরু করেন। বর্ষাকাল বাদে সবসময় গাছের তলায় ক্লাস চলতো। তাঁর জন্যে বেদি গঠন করা হয়। এখনও সেসব রয়েগেছে।

চুনসুরকির দেয়াল, পিলার বাড়ির আদল এখনো কিছুটা অক্ষত রয়েছে। এই আদল জেলার কয়েকটি জায়গায় দেখতে পাওয়া যাবে।

এই বিদ্যালয় ইতিহাসের সাক্ষ্য এখনো বয়ে চলে। বিদ্যালয়ের শিক্ষক শুভেন্দুবাবু বলেন, এই বিদ্যালয়ের কোনায় কোনায় নীলকর সাহেবদের স্মৃতি থাকতে পারে। তাঁরা অত্যাচারি ছিলেন সেটা সবাই জানি।কিন্তু একটা ঐতিহ্য এভাবে হারিয়ে যাবে আমরা কেউ চাই না। তাই সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করি। বিদ্যালয়ের বর্তমান প্রধান শিক্ষক ভূপাল প্রসাদ চক্রবর্তী বলেন, মানুষের আবেগ, আমাদের আবেগের সাথে একাকার হয়ে আছে এই বিদ্যালয় ঘিরে। স্বাধীনতার ৭৫ বছর পার হয়ে এসেও এটা ভাবতে হচ্ছে কবে এই বিদ্যালয় সংরক্ষিত হবে। এই বিদ্যালয়ের এলাকার মানুষের বহু স্মৃতি ঘিরে আছে। এই বিদ্যালয়ের বৃহত্তর এলাকাকে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখতে হলে সরকারি হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।

বিদ্যালয়ের ভূগোলের শিক্ষক তথা পরিবেশপ্রেমি মণিকাঞ্চন রায় বলেন, এই বিদ্যালয়ের সাথে বহু বিল্ডিং র মিল রয়েছে। জেলার ঐসকল বিল্ডিং হেরিটেজের তকমা পেয়েছে। সেদিক থেকে এই বিদ্যালয়েরও পাওয়া দরকার। সেই সাথে উনি বলেন বহু প্রাচীন গাছগুলিকেও সংরক্ষণ প্রয়োজন। কিছু বটগাছ ৩০০ বছরের প্রাচীন বলে মনেহয়। যাকে ঘিরে হাজার হাজার মানুষের আবেগ জড়িয়ে। সরকারিভাবে গান্ধীজি নামাঙ্কিত এই বিদ্যালয়ে বায়ো পার্ক গঠন করা যেতে পারে, সেই সাথে ভগ্নপ্রায় গৃহগুলিকে হেরিটেজ করে সংগ্রহশালা করা যেতে পারে। এলাকার ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ করা দরকার বলে মনে করেন এলাকা বাসী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *