জামাইষষ্ঠীর কথকতা

রিংকি দাস, আমাদের ভারত, ১৫ জুন: স্থায়ী কোনও কিছুই নয়, বিবর্তনই নিয়ম। সময়ের সঙ্গে যেমন সমাজের পরিবর্তন হয় তেমনই বাদ থাকে না সংস্কৃতিও। জামাইষষ্ঠীও এই বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে অনেকটাই পরিবর্তিত হয়েছে। ষষ্ঠীপুজো এখন ঘরের চৌকাঠ পেরিয়ে পদার্পন করেছে আধুনিক শীততাপ নিয়ন্ত্রিত রেস্তোঁরায়। মহামারীর কারনে যদি রেস্তোঁরার দরজায় “ক্লোজ” ঝোলানো থাকে তবে রসনাতৃপ্তির জন্য ‘হোম ডেলিভারি” তো আছেই। অন্যথা শাশুড়ির হেঁসেলে রকমারি পদের সমাহারে উদরপূর্তি আর আমোদ।

বাঙালির জামাইষষ্ঠী আদতে নিজেই বিবর্তনের পথ পেরিয়ে প্রথা, আচারের অনুষ্ঠানিকতা প্রায় তুলে দিয়ে ভোজন আর পারিবারিক আনন্দের অনুষ্ঠানে পরিনত হয়েছে। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে অবশ্য অনুচ্চারিত শব্দে শ্বশুরের পকেট ধ্বংসের ব্যাঙ্গ রসিকতার চল আসছে। সে যাই হোক এই ব্রতর উত্থান আসলে দেবী ষোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত জামাইয়ের সঙ্গে নয়।

এটি লোকায়ত প্রথা। বৈদিক যুগ থেকেই ষষ্ঠীপুজোর প্রথা চলে আসছে হিন্দু সমাজে। প্রতি বছর জ্যৈষ্ঠ মাসে ষষ্ঠী তিথির প্রথম প্রহরে এই পুজোর আয়োজন করা হয়। প্রতিমা কিংবা আঁকা ছবি অথবা ঘট স্থাপন করেই এই পুজো করা হয়।

কথিত আছে, এক গৃহবধূ লোভ সামলাতে না পেরে মাছ চুরি করে খেয়েছিল আর দোষ দিয়েছিল বিড়ালের ওপর। বিড়াল নাকি দেবী ষষ্ঠীর বাহন, কাজেই দেবী রুষ্ঠ হয়ে গৃহবধূর ৭ পুত্র এবং ১ কন্যার প্রাণ হরণ করেন। পরে গৃহবধূ বনে গিয়ে দেবীর আরাধনা করলে দেবী তুষ্ট হয়ে তাঁর পুত্র কন্যার জীবন ফিরিয়ে দেন। তাই এই দেবীর আর এক নাম অরন্যষষ্ঠী আর তখন থেকেই নাকি ষষ্ঠী দেবীর উপাসনা শুরু হয়।
জামাইষষ্ঠী নিয়ে নানা মুণির নানা মত থাকলেও সার কথা একটাই, কন্যার মঙ্গলকামনায় জামাইকে খাতির করা।
অনেকে মনে করেন, আমাদের দেশে বিয়ের পর মেয়ে এবং মেয়ের মা-বাবার জন্য বাঁধা নানা নিয়ম। যেমন, বিয়ের পর এক বছর মেয়ের মা বাবা মেয়ের শ্বশুড়বাড়ি যেতে পারবেন না, আবার মেয়ের যতদিন না কোনও সন্তান হচ্ছে ততদিন মেয়ের বাপের বাড়ি যাওয়া চলবে না। ফলে মেয়ের সাথে দেখা করা, তার খবর নেওয়ার পরিকল্পনায় জামাই আদরের প্রথা আরম্ভ হয়।

আবার অনেকে বলেন, বাল্যবিবাহ, বহু বিবাহ, সতীদাহর মত বিভিন্ন কুপ্রথাগুলির প্রভাব থেকে কন্যাকে যৎসামান্য রক্ষার প্রচেষ্টায় জামাইকে খুশি করতে এই জামাইষষ্ঠীর সূচনা হয়।
জামাইষষ্ঠীর এখন জামাইয়ের জমিয়ে ভুড়িভোজটাই এই পরবের মূল অনুষ্ঠান। শুভারম্ভ হয় জামাইয়ের কপালে দই- চন্দনের ফোঁটা দিয়ে। তার পর ষষ্ঠীদেবীর আশীর্বাদ বলে তেল-হলুদ মাখা সুতো জামাইয়ের কব্জিতে বাঁধা হয়। এরপর শুরু হয় মূল পর্ব।

থালা ভরা মাছ-মাংস তরি-তরকারি ভর্তি পঞ্চব্যঞ্জন। মিষ্টি-দই সহ আয়োজন থাকে নানা ফলমূলের। শাশুড়িরা উপোস থেকে ঘটা করে জামাই পুজো, ষষ্ঠীপুজো দুই-ই করেন। জামাই মেয়ের সমাদরে আহারের সঙ্গে থাকে বস্ত্র পরানোর রীতি। তেমনই জামাইকেও সঙ্গে করে আনতে হয় দই-মিষ্টি, আসে শাশুড়ির পরিধানও।
তবে বর্তমানে এই রীতির বেশ পরিবর্তন ঘটেছে। ব্যাস্ত জীবনযাপন তারই সঙ্গে শরীরে নানা রকমের অসুস্থতা এতসব ব্যাবস্থাপনা করার সাহস জোগায় না। তাই অল্প বেশি হলেও অর্থ ব্যায় করে খাওয়া দাওয়াটা বাইরে সেরে ফেলার রীতিটা শহরাঞ্চলে বেশ চোখে পড়ে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *