রহড়া-খড়দহের দিনগুলি! চুরি হয়ে গেছে ছোটবেলার সেইসব খেলা

রুমালচুরি, বউ বসন্তী, এলাটিং বেলাটিং, হা-ডু-ডু, ডাংগুলি, বাগ-ছাগল রকমারি খেলা। আর ছিল ছোটো ছোটো মেয়েদের চড়ুইভাতি, পুতুলখেলা, ঘর-সংসার, বর-বউ, রান্নাবাটি, খোলামালী খেলা।
(খড়দার ভূমিপুত্র কৃষিবিজ্ঞানী ড. কল্যাণ চক্রবর্তী খড়দায় একাদিক্রমে ৩৫ বছর অবস্থান করেছেন। তার সঙ্গে খড়দার মানুষের দীর্ঘ সাংস্কৃতিক-সাহিত্যিক-সামাজিক যোগসূত্র আজও বিনষ্ট হয়নি। তিনি আপন-চারণায় সমকালীন সময়ের অভিজ্ঞতা শেয়ার করছেন, তার মধ্যে সেই সময়ের স্থানীয় ইতিহাস কিছুটা ফুটে উঠবে এই আশায় তা পরিবেশিত হল। প্রস্তুত প্রতিবেদনটি তার ৭ম পর্ব)

ড. কল্যাণ চক্রবর্তী

আমাদের ভারত, ২৫ ডিসেম্বর: সাতের দশকের মাঝামাঝি সময়। খড়দহ রহড়ার ছোটো ছোটো মাঠগুলিকে তখন এক একটি মুক্ত বিদ্যালয় মনে হত; মনে হত চিরশিশুর আনন্দমেলা। তারওপর পাতুলিয়া, বন্দীপুর, বিলকান্দা, কর্ণমাধবপুরে মাঠজমিতে খেলার আরও বড় আনন্দ অপেক্ষা করে থাকতো। মাঠে মাঠে, জমির আলে আলে ঘুরে বেড়িয়ে যা শিখি, তার জন্য বেত হাতে কোনো মাস্টার মশাই নেই, চোখ রাঙানো কোনো দিদিমনিও নেই। অনাবিল আনন্দ; শেখার কতই না সুযোগ! সবই খেলাধূলার আবর্তে।

শীতের শুরুতে যখন বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হয়ে যেতো, তখন আনুষ্ঠানিক রুটিনও থাকতো না, একটা মিষ্টি-মুক্তি সকাল থেকে সন্ধ্যাে পর্যন্ত মাঠটিকে রাঙিয়ে তুলতো। খেলাধূলার মধ্যে লৌকিক ক্রীড়ার আনন্দ যেন আরও আরও গহন, আরও আরও মধুর। রুমালচুরি, বউ বসন্তী, এলাটিং বেলাটিং, হা-ডু-ডু, ডাংগুলি, বাগ-ছাগল রকমারি খেলা।

আর ছিল ছোটো ছোটো মেয়েদের চড়ুইভাতি, পুতুলখেলা, ঘর-সংসার, বর-বউ, রান্নাবাটি, খোলামালী খেলা। মেয়েদের খেলায় ছোটো ছেলেদেরও আমন্ত্রণ থাকতো। মিছিমিছি ভাত, ডাল, পঞ্চ ব্যঞ্জন, মাছ-মাংস আর পায়েস খাবার আয়োজন আর আপ্যায়ণ। ছোটো নুড়িপাথর কুড়িয়ে মাছ মাংস, বালি দিয়ে ভাত, ধুলোমাটিতে জল ঢেলে ডাল, গাছের লতাপাতার কুচি দিয়ে ব্যঞ্জন। এ করতে গিয়ে কত যে গাছপালা চেনা হয়ে যেত, তার ইয়ত্তা নেই। বেলে পাথর, ঝামা ইঁট, আগ্নেয় শিলা, মাটির প্রকারভেদ — সবই চিনতে শেখেছি। দীপ্ত লুচিপাতা ( _Peperomia pellucida_ ) কাঠি দিয়ে রুটির মত বেলে ভেজা-ভেজা মতোন হলে কচু পাতায় পরিবেশন করা হত।

ডালশস্য পাওয়ার সুলভ সুযোগ ছিল কালকাসুন্দার শুকনো বীজ ( _Cassia sophera/tora/occidentalis_ ) থেকে। টুসটুসে টমেটোর চাটনি হত কাকমাচির ( _Solanum nigrum_ ) পাকা ফল দিয়ে। ছোটোখাটো আঘাত লাগলে, কেটেছড়ে গেলে নানান মেঠো-ভেষজ ব্যবহার করেছি। ঘাস থেঁতো, চুড়চুড়ির রস ( _Croton bonplandianum_ ), গাঁদাগাছের পাতা এসব ছিল রক্ত বন্ধ হওয়ার ওষুধ।

এসব লৌকিক খেলাধূলার আসর নিছক বিনোদন ছিল না, শিক্ষণীয়ও ছিল। লোকজীবনের নির্যাস মাখা এইসব খেলা। ফুটবল, ক্রিকেট খেলার চাইতে কম আনন্দের নয়। খেলার মধ্যে বিজ্ঞান শেখার যেমন সুযোগ আছে, তেমনই আছে ছড়ার সাহিত্য অভ্যাস, সমাজ জীবন সম্পর্কে মূল্যবোধের ধারণা। বহু খেলায় ছড়া বলার বাচিক আনন্দ ছিল। যেমন ‘এলাটিং বেলাটিং সই লো’। এরমধ্যে ছিল এক করুণ রসের কাহিনি, শাসকের নারী লুঠের কদর্য সেই কাহিনী। আর খেলার মধ্যে দিয়ে শেখানো হয় নারীকে রক্ষা করতে হবে, তাদের সম্ভ্রম রক্ষা করতে হবে।

একটা দীর্ঘ অস্থিরতার সময় ছিল বঙ্গে। শাসক বাংলার ঘর গৃহস্থ থেকে নারীকে তুলে নিয়ে যেত, হয়তো তারই এক লৌকিক ইতিহাসের ঝলক খেলার মধ্যে ধরা পড়েছে। “রাজার খবর আইলো।/কি খবর আইল?/একটি বালিকা চাইল।/ কোন বালিকা চাইল?” খড়দহে আরও একটি মেয়েলি খেলা ছিল ‘বউ বসন্তী’ বা ‘বৌমি’, তাতেও নারী লুঠের হারানো ইতিহাসের কথা। কন্যাকে সমবেতভাবে রক্ষা করতে হবে, সমাজ এটাই খেলাধূলার মাধ্যমে শেখাতে চায়। ছোটোবেলা থেকে গোষ্ঠীর পুরুষেরা তাদের মাতৃশক্তিকে রক্ষা করার জন্য শারীরিক ভাবে সক্ষম হয়ে উঠবে, নারীকেও সদাসর্বদা সর্তক থাকতে হবে, এই বার্তা শিশুকাল থেকেই দেওয়া হচ্ছে।

‘রুমালচুরি’ খেলার মধ্যে বার্তাটি এই, এক একটি চোর সমাজের মধ্যে অন্যকেও চোর প্রতিপন্ন করে তুলতে চায়, চোর হয়ে ওঠার প্ররোচনা দেয়। নিজে সাধু সেজে সমাজে বড় স্থানে বসে পড়ে, সমাজসেবী হয়ে ওঠার অপূর্ব অভিনয় করে। বৃত্তাকারে ঘুরে ঘুরে রুমাল (এক্ষেত্রে ‘সম্পদ’) লুকিয়ে বয়ে বেড়ায় সেইসব চোরেরা। সমাজের বোধশক্তির ভয়ে, আরক্ষা বাহিনীর ভয়ে কখনও তা অসতর্ক গৃহস্থের বাড়িতে ফেলে যায় বা অন্যকেও ভাগ দিয়ে চোরাকারবারি করার দলে যুক্ত করে দিতে চায়। সকলের নজর তখন গিয়ে পড়বে গৃহস্থের বাড়িতে। তাই সে চোরাইমাল অন্যত্র সরিয়ে ফেলতে হবে। যদি সরাতে না পারে তবে পুলিশের বা সমাজের কিল হজম করতে হবে। এদিকে চোর সাধু সেজে সমাজে বসে থাকে ঘাপটি মেরে। সামাজিক-রাজনৈতিক বহুস্থলে এ দৃশ্য আজ আর দুর্লভ নয়। অর্থাৎ সমাজের মনস্তাত্ত্বিক দিকটি ধরা পড়েছে খেলাটির মধ্যে।

‘হা-ডু-ডু’ খেলার মধ্যে দেখানো হয়েছে অনুপ্রবেশকারী সমাজে ঢুকে যাচ্ছে। সমাজে নানান অপকর্মের জন্য তারা হানা দিচ্ছে। অবাধে হত্যা করছে, লুঠ করছে, নারী ধর্ষনের মতো জঘন্য অপরাধ সংঘটিত করছে। সমাজ ভীত, তিতিবিরক্ত। অনেকেই অহরহ সমাজ ও স্থাপত্য ভাঙ্গার চেষ্টা চালায়। সমাজের সম্মিলিত প্রতিরোধ না থাকলে এই অনুপ্রবেশ বন্ধ হবে না। দেশ ও রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও তা সমান প্রযোজ্য। আক্রমণ-প্রতি আক্রমণের ঘটনার প্রেক্ষিতে এই খেলা। তখন পাড়ায় পাড়ায় এসব খেলা অনুষ্ঠিত হত। আজ সবই হারিয়ে যাচ্ছে, হারিয়ে যাচ্ছে সামাজিক প্রস্তুতিও।

ডাংগুলি খেলা ছিল গর্ত আর যষ্টি নিয়ে। একটি বড় মাঠ; গর্ত খুঁড়ে তার মধ্যে গুলিটি রেখে ডাং দিয়ে তা সজোরে, সবেগে দূরে ফেলা হয়। এটা একসময়ে খড়দার গ্রামাঞ্চলে কৃষিজীবী রাখালেরাই খেলতো। গর্তটি যেন লাঙ্গল চালিয়ে নির্মিত হয়, তাতে ‘বীছন’ বা বীজ বোনার পালা। রূপক সংকেতের ভাষায় গর্তটি যেন স্ত্রী জননাঙ্গ, যষ্টিটি পুরুষাঙ্গের প্রতীক। অতি তীব্রবেগে শুক্রাণু গতিশীল হবে। অর্থাৎ ডাংগুলি খেলাটি ফার্টিলিটি-কাল্টের একটি অনবদ্য উদাহরণ। তখন আমাদের প্রথাগত যৌনশিক্ষা ছিল না, কিন্তু তার রূপক সংকেত লুকিয়ে ছিল। যত বেড়ে উঠেছি, জীবনের প্রথম পর্বের খেলাগুলি আরও জীবন্ত হয়ে আজ ধরা দিয়েছে। বাংলার লোকসংস্কৃতির একটি হিমশৈলের মতো অনালোচিত অধ্যায় আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

আজ এইসব খেলাগুলি খড়দার বুকে আর দেখা যায় না। খড়দহের একটু ভেতরের দিকে, পল্লী প্রকৃতির বুকে অবশ্য এখনও কিছুটা আছে। পরে ক্রিকেট-ফুটবল জনপ্রিয় হল। আগে খেলার সুযোগ ছিল কিছু ফাঁকা প্লটে, আজ শূণ্যস্থান কোথায়? আজ সকলের খেলার সুযোগ অনুপস্থিত। মা-বাবা আজ আর ছেলেমেয়েদের খেলাধূলার দিকে তেমন নজর দেন না। কেউ পাঠান ক্যারাটে শেখাতে, কেউ যায় সাঁতার শিখতে। হ্যাঁ, অনেকটা পথ সাঁতরে চলে এসেছি আমরা। লোকায়তিক জীবন থেকে অনেক দূরে। জীবনের আনন্দ থেকেও অনেকটা দূরে।

আপনাদের মতামত জানান

Please enter your comment!
Please enter your name here