গোষ্ঠীকোন্দল প্রকাশ্যে, ঠিকাদারকে আগাম পেমেন্টে  গলসীতে বিডিওর কাছে ক্ষোভ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি সহ একাধিক কর্মাধ্যক্ষ ও পঞ্চায়েত প্রধানের 

জয় লাহা, দুর্গাপুর, ২১ জুন: মুখ্যমন্ত্রীর জেলা সফরের আগে শাসকদলের গোষ্ঠীকোন্দল প্রকাশ্যে। ঠিকাদারকে আগাম পেমেন্ট দেওয়ার অভিযোগে কার্যত রোষানলে গলসী-১ নং ব্লক প্রশাসন। খোদ বিডিওর দিকে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে সরব হয়েছে তৃণমূলের এক গোষ্ঠী। সোমবার সমষ্টি উন্নয়ন আধিকারিকের (বিডিও)র কাছে কৈফিয়ত চাইতে গিয়ে ক্ষোভে ফেটে পড়লেন পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতিসহ একাধিক কর্মাধ্যক্ষ, সদস্য, এমনকি ব্লকের একাধিক পঞ্চায়েত প্রধান। ঘটনাকে ঘিরে বিস্তর শোরগোল পড়েছে রাজনৈতিক মহলে। 

প্রসঙ্গত, রাজ্যে তৃতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর অবৈধ বালি, মাটি চোরাচালান থেকে দুর্নীতি দমন তৎপর হয়েছে রাজ্য সরকার। মুখ্যমন্ত্রী জেলা সফরে গিয়ে আমলা থেকে দলীয় কর্মী ও দলের জনপ্রতিনিধিদের কড়া বার্তাও দিয়েছেন। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে তৎপরতার সঙ্গে পালন করছেন রাজ্যের আমলারা। মিড-ডে মিলের রান্নাঘর সংস্কারে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে সরব হয়েছে  গলসী-১ ব্লকের তৃণমূলের গোষ্ঠী। তাতে পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি, সদস্য, এমনকি একাধিক পঞ্চায়েতের প্রধান ও পঞ্চায়েত সমিতির কয়েকজন কর্মাধ্যক্ষরা রয়েছেন। উল্লেখ্য, লকডাউনে স্কুল বন্ধ থাকায় মিড ডি মিলের রান্নাঘরে বেহাল হয়ে পড়েছে। যুদ্ধকালীন তৎপরতায় ওইসব রান্নাঘর মেরামতের জন্য অর্থ বরাদ্দ হয়। সেই মত গলসী-১ নং ব্লকে মিড-ডে মিলের রান্নাঘর মেরামতের টেন্ডার আহ্বান করা হয়। সেই মত কাজও শুরু হয়। জানা গেছে, গলসী-১ নং ব্লকের ১৪৪ টি প্রাইমারি ও আপার প্রাইমারি স্কুলের জন্য প্রায় ১৪ লক্ষ টাকা অনুমোদন হয়। গত মার্চ মাসে একটি সংস্থা কাজের বরাত পায়। অভিযোগ কাজ সম্পুর্ন হওয়ার আগেই ওই ঠিকা সংস্থাকে পেমেন্ট পাইয়ে দেওয়া হয়েছে। গত ২৯ এপ্রিল ৪ লক্ষ ৪৭ হাজার ৩৪০ টাকা ও গত জুন মাসে ৯ লক্ষ ২৪ হাজার ৫৫৭ টাকা। আর তাতেই ক্ষোভে ফেটে পড়েন ব্লকের মানকর, চাকতেঁতুল, লোয়া কৃষ্ণরামপুর, লোয়ারামগোপালপুর সহ একাধিক পঞ্চায়েত প্রধান। এমনকি পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতিসহ একাধিক কর্মাধ্যক্ষ ও সদস্য। সোমবার বিডিওর বিরুদ্ধে স্বজনপোষন ও দুর্নীতির অভিযোগ তুলে বিডিও র কাছে কৈফিয়ত জানতে চায় তারা। ইতিমধ্যে ক্ষুব্ধ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি, কর্মাধ্যক্ষ, সদস্য, পঞ্চায়েত প্রধানরা তাদের স্বাক্ষরিত অভিযোগ জেলাশাসকের কাছে লিখিত ভাবে জানাচ্ছেন। তাদের দাবি, “কাজ না করে পছন্দের ঠিকাদারকে সম্পুর্ন পেমেন্ট পাইয়ে দেওয়া হয়েছে। তাতে দুর্নীতি হয়েছে। তারই প্রতিবাদ করেছি।” চাকতেঁতুল পঞ্চায়েত প্রধান অশোক ভট্টাচার্য্য দাবী করে বলেন,
“পঞ্চায়েত সমিতিতে যদি এধরনের আগাম পেমেন্ট দেওয়ার সুবিধা থাকে। তাহলে পঞ্চায়েতেও ঠিক একইভাবে বরাত পাওয়া ঠিকাদারদের কাজের আগাম পেমেন্ট দেওয়ার ব্যাবস্থা করা হোক। এবং কাজ করার পরও বকেয়া যে পেমেন্ট রয়েছে, সেগুলো মিটিয়ে দেওয়া হোক।” এখন প্রশ্ন, খোদ বিডিওর বিরুদ্ধে এধরনের ক্ষোভের কারন কি? না, এর পিছনে অন্য কোন কারন লুকিয়ে আছে? 

গলসী-১ নং পঞ্চায়েত সমিতি সহ ৯ টি পঞ্চায়েত তৃণমূলের দখলে। তারপরও এধরনের অভিযোগ তোলায় তৃণমূলের গোষ্ঠীকোন্দল যে প্রকাশ্যে, সেটা বলা বাহুল্য। প্রসঙ্গত, গলসী-১ নং ব্লকে একসময় তৃণমূলের প্রক্তান পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি তথা প্রাক্তন ব্লক সভাপতি জনার্দ্দন চ্যাটার্জী ও দলের জেলা সহ সভাপতি জাকির হোসেনের দ্বন্দ্ব চলছিল। গত ডিসেম্বর মাস থেকে জাকির হোসেন গোষ্ঠীরও ফাটল ধরে। একসময়ের জাকিরবাবুর ঘনিষ্ট গলসী-১ নং পঞ্চায়েত সমিতির সহ সভাপতি অনুপ চট্টোপ্যাধ্যায়ের সঙ্গে মতানৈক্য শুরু হয়। দলের ব্লক কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়েছে। নতুন ব্লক সভাপতি কে হবে সে নিয়ে বিস্তর জল্পনা শুরু হয়েছে। দলের ব্লক সভাপতির দৌঁড়ে অনেকটাই এগিয়ে অনুপ চ্যাটার্জী। আর সেই কারনেই কি দলের অন্তর্দ্বন্দ্ব? যদিও আরও একটি গোষ্ঠীর উৎপত্তি হয়ে শাসকদলের দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে চলে আসে। এছাড়াও গলসী-১ নং ব্লকের পারাজ- রামগোপালপুর সড়কের ওপর পারাজ ক্যানেল সেতু দীর্ঘদিন ধরে বেহাল ছিল। মেরামতের কাজ হলেও ভারি যান চলাচল নিষিদ্ধ হয়ে পড়ে। এদিকে দামোদর নদের শিল্ল্যা, সোদপুর বালিঘাটের বালি বোঝাই লরি যাতায়াত থমকে যায়। বালির লরি যাতায়াতের সুবিধার জন্য জরাজীর্ন সেতুর অদুরে কাঠের বিকল্প সেতু তৈরী করেন হেমন্ত ঘোষ এক বালি কারবারি। অভিযোগ ওঠে ওই সেতুর ওপর অবৈধভাবে লরি পিছু আড়াই’শ টাকা করে টোল আদায় করা হচ্ছে। তাও আবার রশিদ ছাপিয়ে। দৈনিক প্রায় ৫০ হাজার টাকার ওপরে টোল আদায় হচ্ছিল। কিন্তু ওই আদায় করা টোল কোথায় জমা পড়ছে তারও কোন হদিস নেই। সে বিষয়ে দলের ভেতরে বাইরে চরম ক্ষোভ  সৃস্টি হয়। সব মিলিয়ে বছরে প্রায় কয়েক কোটি টাকার অবৈধভাবে টোল আদায়ের অভিযোগ ওঠে। অভিযোগ শাসকদলের এক জেলার নেতার মদতে ওই টোল আদায় চলছিল বলে অভিযোগ। বিষয়টি নজরে পড়তেই নড়েচড়ে বসে প্রশাসন।  এবং ওই কাঠের সেতুর ওপর টোল আদায়ে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। শুধু তাই নয়, টোল আদায়ের এলাকায় সেচ ক্যানেল পাড়ে অবৈধভাবে তৈরী করা বিল্ডিং ভেঙে ফেলা হয়। এমনকি দামোদরের ওপর অবৈধভাবে বালির চোরাচালেনের ওপর কঠোর পদক্ষেপ নেয় প্রশাসন। সব মিলিয়ে অবৈধভাবে চলা বালি পাচার বন্ধ ও টোল আদায় বন্ধ হয়ে পড়ে। স্থানীয় বিজেপি নেতা রমন শর্মা কটাক্ষ করে বলেন,” মৌঁচাকে ঢিল পড়েছে। তাই গোষ্ঠীর মধ্যেও গোষ্ঠী তৈরী হয়েছে। নিজেদের প্রশাসনের দিকে অভিযোগ তুলে দুর্নীতির অভিযোগ তুলছে। এটা থেকে প্রমানিত তৃণমূলের মদতে অবৈধভাবে বালি পাচার ও অবৈধভাবে টোল আদায় হয়েছে। তাই বালি পাচার ও অবৈধ টোল আদায় থেকে এসব দুর্নীতির সিবিআই তদন্ত হওয়া দরকার।” তবে এদিন ঠিকাদারকে আগাম পেমেন্ট দেওয়ার অভিযোগের প্রসঙ্গে বিডিও দেবলিনা দাস বলেন,” নিয়ম মেনে কাজ করা হয়েছে। মিড-ডে মিলের রান্নাঘর সংস্কারের কাজ চলছে। ৪০ টা স্কুলের কাজ হয়েছে। বাকি স্কুলের কাজ ১০-১২ দিনের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে।” 

গলসী-১ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি অনুপ চট্টোপাধ্যায় বলেন,” নিয়ম মেনে কাজ হচ্ছে। পরিকল্পিত ভাবে কিছু স্কুলের কাজে বাধা দেওয়া হচ্ছে। বিষয়টি নজরে রেখে সতর্ক করা হয়েছে। এভাবে হেনস্থা করলে প্রয়োজনে আইনানুগ ব্যাবস্থা নেওয়া হবে। পেমেন্ট দেওয়ার বিষয় পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি জানেন। এখন তিনি কেন জানেন না বলছেন, সেটা বুঝতে পারছি না।” তিনি আরও বলেন,” মাস কয়েক আগে স্বচ্ছতা রাখতে পারাজ সড়কের ওপর টোল আদায়ের টেন্ডার করা হয়েছিল। হুমকি কে উপেক্ষা করে স্বচ্ছতা বজায় রাখতে অনলাইন টেন্ডার করা হয়। এছাড়ও পারাজে সেচ ক্যানেলে কাঠের সেতুর ওপর অবৈধভাবে টোল আদায় বন্ধ করা হয়েছে। 

বিডিও স্বচ্ছতার সঙ্গে কাজ করছেন। দুর্নীতি দমনে ও অবৈধ কাজের বিরুদ্ধে কঠোর হওয়াই  আক্রোশ বলে মনে করছি।” যদিও এবিষয়ে গলসীর তৃনমূলের প্রাক্তন ব্লক সভাপতি জাকির হোসেনের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা হলে, কোন বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে

তৃণমূলের আর এক প্রক্তান পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি তথা প্রাক্তন ব্লক সভাপতি জনার্দ্দন চ্যাটার্জী জানান,
“বিডিও আইনের ঊর্ধ্বে নয়। অভিযোগ থাকলে তাঁর ঊর্ধ্বতন আধিকারিকের কাছে অভিযোগ জানাতে পারে। তার ওপর তদন্ত হবে। তদন্তে দোষী প্রমানিত হলে আইনানুগ ব্যাবস্থা হবে।” পুর্ব বর্ধমান জেলাশাসক প্রিয়াঙ্কা সিংলা জানান,” এবিষয়ে কোন অভিযোগ আসেনি।”

এদিকে কয়েকদিন পর পূর্ব বর্ধমান জেলায় মুখ্যমন্ত্রী সফরে আসছেন। তার আগে দলের গোষ্ঠীকোন্দল প্রকাশ্যে আসতেই কার্যত চরম অস্বস্তিতে পূর্ব বর্ধমান জেলা তৃণমূল কংগ্রেস নেতৃত্ব। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *