আমাদের ভারত, ১৯ জানুয়ারি: আইএএসদের বদলি নিয়ে শুরু হয়েছে কেন্দ্র-রাজ্য চাপানউতোর। প্রশ্ন উঠেছে এর যৌক্তিকতা নিযেও। বিষয়টির ভালমন্দ তাঁর অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে ব্যাখ্যা করলেন প্রাক্তন চিফ পোষ্ট মাস্টার জেনারেল গৌতম ভট্টাচার্য। তাঁর মতে, ফেডারেল ব্যবস্থায় কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে বোঝাপড়াটা গুরুত্বপূর্ণ, পরস্পরকে টেক্কা দেওয়া নয়।“
এ প্রসঙ্গে এই প্রতিবেদককে তিনি জানান, “আইএএস, আইপিএস এবং ইন্ডিয়ান ফরেষ্ট সার্ভিস— এই তিনটিকে ভারতের সংবিধানে অল ইন্ডিয়া সার্ভিস নামে আলাদাভাবে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকার এবং রাজ্য সরকারের বিভিন্ন সার্ভিসের বাইরে, এই অল ইন্ডিয়া সার্ভিসগুলোর অস্তিত্ব ভারতীয় সংবিধানের একটা ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট। যদিও কেন্দ্রীয় সরকার এই তিনটি সার্ভিসের অফিসারদের নিয়োগ করেন, কর্মজীবনের শুরুতেই এনাদের বিভিন্ন রাজ্যে নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয় এবং সেই থেকে এর অফিসারদের প্রধান দায়বদ্ধতা থাকার কথা রাজ্য সরকারের প্রতি।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে সংবিধান নির্মাতারা কেন কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের বিভিন্ন সার্ভিসের বাইরে সর্বভারতীয় সার্ভিস নাম দিয়ে আলাদা কিছু সার্ভিসের কথা ভেবেছিলেন? এর উত্তর খুঁজতে গেলে সংবিধানের দিকেই আবার চোখ ফেরাতে হবে। কিছু ধরণের কাজ আমাদের সংবিধানে কেন্দ্রীয় সরকারের জন্য নির্দিষ্ট রাখা হয়েছে। যেমন পররাষ্ট্রনীতি, রেল, ডাক যোগাযোগ, টেলি-কম্যুনিকেশনস, তথ্য ও সম্প্রচার ইত্যাদি।
কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন সার্ভিসের আধিকারিকরা এই সমস্ত কাজের সামাল দেন। কিছু কিছু কাজ আছে যেগুলি রাজ্য সরকারের জন্য নির্দিষ্ট, যেমন ধরা যাক মদের ওপর আবগারি শুল্ক কি হবে সেটা নির্ধারণ করার দায় রাজ্যের। রাজ্যের রাজস্ব পরিষেবার অফিসাররা সে কাজে সামাল দেন। কিন্তু এমন বহু কাজ আছে যেটা সাধারণভাবে রাজ্য সরকারের দায়িত্ব হলেও কেন্দ্রের একটা ভূমিকা থাকে।
অল ইন্ডিয়া সার্ভিসগুলো ঠিক ওই ধরণের কাজের কথা মাথায় রেখেই তৈরী হয়েছিল। একজন আইএএস অফিসার যখন জেলাস্তরে কাজ করলেন, আরও অনেক কিছুর সঙ্গে তাঁর জেলায় কৃষিপণ্য বাজার সম্পর্কে একটা সম্যক ধারণা হলো। পরবর্তীতে তিনি যখন রাজ্য সরকারের কৃষি দপ্তরে কাজ করলেন, সেই অভিজ্ঞতাটাই আরো পরিপূর্ণতা লাভ করলো। ইনিই যখন ভবিষ্যতে কেন্দ্রীয় সরকারের কৃষি দপ্তরে নীতি নির্ধারণে যাবেন, জেলা ও রাজ্যস্তরে কাজ করার অভিজ্ঞতা তখন তাঁর কাছে অমূল্য সম্পদ।- ঠিক এইখানেই হল অল ইন্ডিয়া সার্ভিসের সার্থকতা।
এখন প্রশ্ন হল কখন একজন অল ইন্ডিয়া সার্ভিসের অফিসার রাজ্য থেকে কেন্দ্রে যান ডেপুটেশনে। এর তিনটি দিক আছে। প্রথমত অফিসারটিকে ব্যক্তিগত স্তরে ডেপুটেশনে যেতে আগ্রহী বা নিদেনপক্ষে ইচ্ছুক হতে হবে। দ্বিতীয়ত কেন্দ্রীয় সরকারকে তাকে ডেপুটশনে নিতে রাজী হতে হবে। তৃতীয়ত রাজ্যকে রাজী হতে হবে সেই অফিসারকে কেন্দ্রের ডেপুটেশনের জন্য ছাড়তে। অনেক সময়ই দেখা যায় ডেপুটেশনে ইচ্ছুক এবং কেন্দ্রের মনোনীত অফিসারকে রাজ্য ছাড়তে গড়িমসি করছে।
এই গড়িমসির দৃষ্টান্ত ইদানীংকালে বেড়েছে এবং তার অন্যতম কারণ সংখ্যায় অফিসারের অভাব। যেহেতু ২০০২-০৯ সালে বিভিন্ন কেন্দ্রীয় দপ্তরে এবং অল ইন্ডিয়া সার্ভিসে মোট খালিপদের এক-তৃতীয়াংশ ভর্তি করা হয়েছিল, আজকে সিনিয়ার লেভেলে কেন্দ্রীয় সরকারে এবং অল ইন্ডিয়া সার্ভিসে উপযুক্ত সংখ্যায় অফিসার পাওয়া যাচ্ছে না। তাই রাজ্য অফিসারকে না ছাড়লে কেন্দ্রের গোঁসা বাড়ছে।
এই দুর্দশা আরো দু’দশক চলবে। তাই ভাবনা চিন্তা চলছে, রাজ্য না ছাড়লেও বা অফিসার ইচ্ছুক না হলেও জোড় করে তাঁকে কেন্দ্রের ডেপুটেশনে আসতে বাধ্য করা। যদি রাজ্যস্তরে বিরোধিতা উপেক্ষা করে সত্যি-সত্যিই এই ব্যবস্থা লাগু হয় তবে রাজ্যে সেই শূন্যস্থান পূর্ণ করবেন রাজ্যস্তরের সিভিল সার্ভিস অফিসাররা এবং রাজ্যের শাসন ব্যবস্থায় কিছুটা হলেও অল ইন্ডিয়া সার্ভিসের ভূমিকা গৌণ হয়ে যাবে।
কিন্তু তার চেয়েও বড়ো কথা হচ্ছে, যে বোঝাপড়ার মাধ্যমে ভারতের ফেডারেল ব্যবস্থা এতোদিন চলে এসেছে তাতে একটা বড়ো আঘাত লাগবে। ফেডারেল ব্যবস্থায় কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে বোঝাপড়াটা গুরুত্বপূর্ণ, পরস্পরকে টেক্কা দেওয়া নয়।“