
আশিস মণ্ডল, আমাদের ভারত, শান্তিনিকেতন, ২৮ মার্চ: মোদী স্তুতি সমাবর্তনে উপাচার্যর স্বাগত ভাষণে। নিন্দায় মুখর সব মহল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও নরেন্দ্র মোদীকে একই আসনে বসানোকে কেউ কেউ পাগলের প্রলাপ বলে কটাক্ষ করেছেন।
সমাবর্তনে স্বাগত ভাষণে উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তী, দুএকটা উদাহরণ দিয়ে বলেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পাঁচটি গ্রাম “গোদ” নিয়েছিলেন। আজকে সেটির সংখ্যা ষাট। একইভাবে দুই হাজার পনেরো সালে নরেন্দ্র মোদী প্রত্যেক সাংসদকে পাঁচটি গ্রাম গোদ নেওয়ার কথা বলেছিলেন। উপাচার্যর মুখে এই কথা শোনার পর সকলেই বলছেন রবীন্দ্রনাথের গ্রাম নিয়ে ভাবনার পর মোদীর গ্রাম দত্তক নেওয়ার কথা আসে কি করে? কিসে আর কিসে। সুপ্রিয় ঠাকুর বলেন, উনি সব সময় বিতর্ক তৈরি করতে ভালোবাসেন। তাই উনার কথার পিঠে কিছু বলতে ইচ্ছে হয় না। প্রবীণ আশ্রমিক সুবীর বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, এসব পাগলের প্রলাপ। কিছু বলার নেই। আশ্রমিকদের আমন্ত্রণ পাঠানোর প্রথা তুলে দিয়েছেন। শুনেছি অনেককেই ঢুকতে দেননি।
প্রাক্তন ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য সবুজ কলি সেন বলেন, ১৯২২ সালে পাঁচটি গ্রামের দায়িত্ব নেয় বিশ্বভারতী। তাই তার সঙ্গে এসব কি? ২০১৫-১৭ বাহান্ন থেকে ষাটটি গ্রামের দায়িত্ব নেয় বিশ্বভারতী। বর্তমান উপাচার্য এসেছেন তার অনেক পরে। রবীন্দ্রনাথের গ্রাম বা পল্লীপুনর্গঠনের ভাবাদর্শকে মোদীর সঙ্গে গুলিয়ে দেন উপাচার্য। তিনি সমগ্র সমাবর্তন অনুষ্ঠান এই প্রথম বাংলা ও হিন্দি সঞ্চালনার মাধ্যমে এগিয়ে নিয়ে যান। যেটা আগে সঞ্চালনা ছাড়াই হতো। এটা তিনি রীতি ভাঙলেন। কয়েকজন পছন্দের মানুষের প্রবেশাধিকার ছিল। অনেক ছাত্র ছাত্রী আসেইনি।
ছাত্র সোমনাথ সৌ বলেন, আমার তো সপ্তপর্ণী নেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আমার কথা আমি পরিদর্শককে জানাতে পারতাম না। বিশ্বভারতীর নিরাপত্তা রক্ষী আমাদের হেনস্তা করতো। তাই বাড়ি চলে যাই। একইরকম ভাবে অনেকেই যায়নি। অধ্যাপক সুদীপ্ত ভট্টাচার্য জানান, অনেক অধ্যাপক, আশ্রমিক, প্রাক্তনী, পড়ুয়া যেতে পারেননি। আমরাও যাইনি।
উপাচার্য নিজের কৃতিত্ত্বের তালিকায় জানান, একমাসের মধ্যে বিশ্বভারতী ইউনেসকো হেরিটেজের স্বীকৃতি পেতে চলেছে। যদিও এই প্রচেষ্টা উপাচার্য সুজিত বসু, রজত রায়ের সময় থেকে শুরু হয়েছে। যার কৃতিত্ত্ব তিনি নিজে নিতে চাইছেন। পাশাপাশি, উপাচার্য বলেন, অতিমারির সময় ত্রাণ দিয়েছে বিশ্বভারতী। এখানেও একটি অসত্য লুকিয়ে আছে। শান্তিনিকেতন ট্রাস্টকে না জানিয়ে চুরানব্বই হাজার ট্রাস্টের টাকা তিনি এই ত্রাণের ক্ষেত্রে ব্যায় করেছেন। সবথেকে লজ্জার বিষয় উপাচার্য যেভাবে ছাত্রদের অনুষ্ঠানে ছাত্রদের এবং আশ্রমিকদের ঠেকাতে নিরাপত্তাব্যবস্থার নামে যে নিদর্শন স্থাপন করলেন তা লজ্জার। ভিবিইউএফএ’র তরফে বলা হয় যে, অশিক্ষক কর্মীদের মধ্যে যারা সেকশন অফিসারের নিচের স্তরগুলিতে কাজ করেন, যেমন করণিক বা গ্রুপ ডি স্টাফ, তারা এই সমাবর্তনে ব্রাত্য। অথচ এই অশিক্ষক কর্মী দিয়েই সমাবর্তন উপলক্ষে শনিবার ও রবিবার বিশ্বভারতীর সব ভবন ও বিভাগের অফিস খুলিয়ে কাজ হয়েছে। এমন শ্রেণী বৈষম্য কী তার নিজের প্রতিষ্ঠানে হতে পারে কোনো দিন ভাবতে পেরেছিলেন গুরুদেব? বিশেষত যেখানে সমাবর্তনের পৌরহিত্য করছেন ভারতবর্ষে প্রথম আদিবাসী সম্প্রদায় থেকে উঠে আসা মহিলা রাষ্ট্রপতি। বিদ্যুৎ চক্রবর্তীর এমন ভেদাভেদমূলক নীতির তীব্র ধিক্কার জানাই।
আশ্রমিকরা প্রতিবাদে মুখর হয়ে বলছেন, উপাচার্য মাসে মাসে সমাবর্তন করছেন। কিছুদিন আগে একুশের সমাবর্তন হলো। আজ হলো বাইশের। সামনে হবে তেইশের। নিজের রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করতে মাসে এত ব্যায় ভার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর চাপাচ্ছেন। দেরি যখন হলো, একসঙ্গে একুশ বাইশ তেইশ করা যেত। এক খরচে হতো।
এদিন সাড়ে বারোটায় কুমিরডাঙা হ্যালিপ্যাডে নেমে রথীন্দ্রনাথ অতিথি শালায় বিশ্রাম নিয়ে রাষ্ট্রপতি উদয়ন কবিগৃহে মাল্যদান করে রবীন্দ্রভবন যান। সেখানে ভিজিটরস বুকে সই করেন। রবীন্দ্রভবন ছাড়াও কলাভবন পরিদর্শন করেন। তারপর বেলা তিনটায় আম্রকুঞ্জে জহরবেদিতে যান। সেখানে ছাত্রছাত্রীর উদ্দেশ্যে বলেন, বিশ্বভারতীতে দেখছি যত ছাত্র তত ছাত্রী। তাদের সমন্বয় দরকার। দেশে পঞ্চাশ শতাংশ মহিলা। মহিলার শিক্ষা, আত্মনির্ভরতা, আজ দেশের কাছে চুনতি। এই চুনতি বিশ্বভারতী থেকেই পূরণ হবে। এখানে প্রকৃতির কোলে গাছের নীচে পাঠদান হয়। গুরুদেব যে গাছের নীচে বসে ধ্যান করতেন সেটা দেখলাম। গাছের নীচেই বিবেকানন্দ, বুদ্ধ সিদ্ধিলাভ বা জ্ঞান লাভ করেন। এভাবেই এখানে প্রকৃতির কোলে শিক্ষা লাভের কথা আগেও শুনেছি। এবার চাক্ষুষ করলাম।