শব্দবাজি নিয়ন্ত্রণ, মন্ত্রীর কথা আর কাজের মিল কোথায়?

অশোক সেনগুপ্ত
আমাদের ভারত, কলকাতা, ২৫ অক্টোবর: শব্দবাজি নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে রবিবারই রাজ্যের পরিবেশমন্ত্রী মানস ভুঁইয়া আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি বলেন, ‘‘পুলিশ-প্রশাসনের তরফে সর্বতোভাবে চেষ্টা করা হচ্ছে। আমাদের দফতর প্রতিনিয়ত পুলিশ, পুরসভার সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে।’’ কিন্তু তাঁর আপ্তবাক্যের রূপায়ণ আর বাস্তব ছবির মধ্যে ব্যবধান কতটা, তা দেখিয়ে দিল কালীপুজোর রাত। দাপুটে, কর্মনিষ্ঠ মন্ত্রীও অসহায় আইনভঙ্গকারীদের কাছে।

যত ক্ষণ বৃষ্টি হচ্ছিল, তত ক্ষণ একটু চুপচাপ। বৃষ্টি থামতেই প্রতি বছরের মতো একই ঘটনা ঘটল। চলতি বছরেও কলকাতা ও শহরতলি-সহ রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় শব্দবাজির আওয়াজে রীতিমতো অতিষ্ঠ হলেন সাধারণ নাগরিক। ত্রস্ত পশুপাখিরা। পরিস্থিতি দেখে মনেই হচ্ছিল না যে, শব্দবাজির উপরে সুপ্রিম কোর্ট, কলকাতা হাই কোর্টের বিন্দুমাত্র কোনও নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। যেন আদালতের তরফে সম্পূর্ণ ভাবে ছাড় দেওয়া হয়েছে শব্দবাজিকে! নিষেধাজ্ঞার পরেও এই ঘটনা কী ভাবে ঘটতে পারে, তা নিয়ে বিস্মিত সচেতন নাগরিক এবং পরিবেশকর্মীরা।

প্রতি বছরের মতো এ বারেও বাজি সংক্রান্ত যে কোনও অভিযোগ গ্রহণের জন্য আজ রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ কন্ট্রোল রুম চালু করে। সূত্রের খবর, সন্ধ্যায় সেই কন্ট্রোল রুমে হাজিরা দেন রাজ্যের পরিবেশমন্ত্রীও। একই সঙ্গে পরিবেশকর্মীদের সংগঠন ‘সবুজ মঞ্চ’-এর কন্ট্রোল রুমও চালু হয়। এ বছর সংগঠনের তরফে একটি নতুন নম্বর চালু করা হয় (৬২৯০৯০১৮৬২), যেখানে বছরভরই শব্দদূষণ সংক্রান্ত অভিযোগ জানানো যাবে।য়কত অভিযোগ এসেছে, সে হিসাব অবশ্য এখনই পাওয়া যাবে না।

পরিবেশকর্মীদের সংগঠন ‘সবুজ মঞ্চ’-এর সাধারণ সম্পাদক নব দত্ত জানাচ্ছেন, তাঁদের অভিজ্ঞতায় এই বছরের কালীপুজো অন্য দিক থেকে ব্যতিক্রমী। কারণ, কালীপুজোর আগের দিন থেকেই এত শব্দবাজি ফেটেছে যে, তা সচরাচর দেখা যায়নি। তাঁর কথায়, ‘‘এটা সম্পূর্ণ রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের ব্যর্থতা। পর্ষদ প্রতি বার শব্দবাজি আটকানোর বিষয়ে অনেক দাবি করে। বাস্তবে তার কোনও প্রতিফলন দেখা যায় না। এ বার তো সরাসরি আদালতের নির্দেশের অবমাননা করা হল।’’

পরিবেশ ও সমাজকর্মী বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায় জানিয়েছেন, শব্দদানবের হাত থেকে বাঁচার তাগিদেই মানুষই আবার সৃষ্টি করল নানাবিধ আইন। আইনের সুচারু প্রয়োগের পথ প্রশস্ত হয়েছে মহামান্য কোলকাতা হাইকোর্টের মাননীয় বিচারপতি ভগবতীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রদত্ত এক বিচারের বাণীর মধ্য দিয়ে। ঘোষিত হল কোন মানুষ কোন মানুষকে বন্দী বা দাস শ্রোতাতে পরিণত করতে পারবেন না। মত প্রকাশের স্বাধীনতা যেমন আবশ্যিক গণতন্ত্রের স্বার্থে, সভ্যতার অগ্রগতির প্রয়োজনে, ঠিক তেমনি কোন কিছু শুনতে না চাওয়াও জীবনের পক্ষে অপরিহার্য। মানবজীবনে শব্দের প্রয়োজন যেমন আবশ্যিক ঠিক তেমনি নৈঃশব্দও জীবনের অপরিহার্য সঙ্গী। ১৯৯৬ -র এপ্রিলে মাননীয় বিচারপতি ভগবতীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় এক ঐতিহাসিক তথা গুরুত্বপূর্ণ রায় প্রদান করেন। শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ এই ঐতিহাসিক রায়কে সুরের অসুর নিধনে এক অমোঘ বাণী রূপে গ্রহণ করেছেন। বাস্তবিকই এই রায় আজ এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। বিচারপতির এই রায় সাধারণ মানুষের কল্যাণার্থে প্রদত্ত। তাই একে কার্যকরী করা আজ অত্যন্ত জরুরি। সমাজের সকল স্তরের মানুষের দৃঢ় মানসিকতা আগামী দিনে এই রায়কে কার্যকরী করতে হবে।

রাজ্যবাসীর প্রশ্ন, আদালতের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও শব্দবাজিকেই পুলিশ-প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে, সার্বিক আইন-কানুন কী ভাবে রক্ষা হবে রাজ্যে? কারণ, পুরো ঘটনা তো শুধু শব্দবাজি ও তার দাপট, জনস্বাস্থ্যের উপরে তার খারাপ প্রভাবের উপরেই সীমাবদ্ধ নেই। বরং এর সঙ্গে আদালতের রায় মান্য করার বিষয়টিও জড়িয়ে রয়েছে। সেই নির্দেশ পালনে ব্যর্থতা মানে, তা আদালত অবমাননার শামিল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *