বিশ্বকর্মা পুজোয় শৈশবের স্মৃতিচারণ শিক্ষাবিদের

আমাদের ভারত, ১৭ সেপ্টেম্বর: বিশ্বকর্মা পুজোয় শৈশবের স্মৃতিচারণ করলেন শিক্ষাবিদ ডঃ অনিল ভুঁইমালি।

প্রাক্তন উপাচার্য তথা উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক অনিলবাবু এই প্রতিবেদককে জানালেন, “আজ ছুটি, শনিবার। বিশ্বকর্মা পুজো উপলক্ষ্যে সবাই বাড়ির বাইরে যে যার মতো তাদের গাড়ি, স্কুটার, মোটর সাইকেল, এমনকি সাইকেল বের করে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করছে। ভালোই লাগছে। আকাশ মেঘে ঢাকা, সব সময় গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পড়ছে। সকালে একটু কম লোকজন হাঁটতে বেরিয়েছে মনে হলো। পড়ার চাপ নেই, নেই কোনো অ্যাসাইনমেন্ট। প্রজেক্টের কাজ আজ নাই–বা করলাম। প্রায়শই মনটা কেন যেনো বেদনাতুর হয়ে ওঠে, ভারাক্রান্ত বোধ করি।

১৯৭৬এর ডিসেম্বরের এক বিকেলের সেই সারা জীবন মনের মণিকোঠায় স্থান পাওয়া ছুটের কথা মনে পড়ে গেলো। আমাদের অঞ্চলের একমাত্র স্কুল ছিল নেহেম্বা জুনিয়র হাই স্কুল। ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়ানো হতো সেই সময়। স্কুলের হেড মাস্টারমশাই ছিলেন শ্রী ষষ্ঠীদাস ভট্টাচার্য মহাশয়। আমাদের বছর দুয়েক আগে স্কুল কর্তৃপক্ষ একটা প্রচেষ্টা চালায় ক্লাস নাইন খোলার।

রঞ্জনদারা প্রথম এক্সটার্নাল হিসেবে পরীক্ষা দেয় নেহেম্বা স্কুল থেকে। তো দুইবছর পর আমাদের একই ভাবে পরীক্ষা দিতে হবে। উদয়, ঝিটকাহার, নেহেম্বা, বড়োম, বত পুকুর, পঞ্চগ্রাম, জগদীশপুর, চালুনদা, ভেড়াডাঙ্গার ছেলে মেয়েদের এভাবেই পড়াশোনা করতে হতো— তাদের যেমনই আর্থিক অবস্থা হোক না কেনো। এক্সটার্নাল হিসেবে পরীক্ষা দিতে হলে জেলা শহরের একটি স্কুলে সেন্টার করা হতো তাদের টেষ্ট পরীক্ষার জন্য।

আমাদের সেন্টার হয়েছে বালুরঘাট খাদিমপুর হাই স্কুলে। রমেশ, সত্যেন, আমি ঠিক করলাম, রমেশের দিদি থাকে বালুরঘাটের হুসেনপুরে, সেখান থেকেই পরীক্ষা দেবো। এই প্রথম বালুরঘাট যাওয়া। তার আগে একবার মাত্র গঙ্গারামপুর গিয়েছিলাম ফটো তুলতে। আমরা দুপুরে খেয়ে দেয়ে রওনা হলাম। হেঁটে চললাম রামপুরে। সেখান থেকে বাসে উঠতে হবে।সাত কিমি রাস্তা।

হরসুরা, মহাদেবপুর পেরিয়ে একটা খাড়ি। খাড়ি দিয়ে জল বইছে। কোনো ব্রিজ বা সাঁকো নেই। সেই খাড়ি পেরিয়ে রামপুর। আমরা সবাই আমাদের বই পত্র, একটা করে জামা নিয়ে (আমার আলাদা কোনো জামা ছিল না, যেটা পরে গিয়েছিলাম সেটি ছাড়া)। বিকেল হলো রামপুর পৌঁছতে। তার পর বাস ধরে বালুরঘাট বাস স্ট্যান্ড। মোটর কালীবাড়ির পাশেই বাসস্ট্যান্ড। আমরা আমাদের জিনিসপত্র নিয়ে নামলাম। সত্যেন নেমেই টিনের বাক্স খুলে দেখে নিল ওর জিনিসপত্র। আমিও আমার ব্যাগ খুলে দেখলাম, দেখলাম আমার সব ঠিক আছে কিনা। দেখলাম অ্যাডমিট কার্ডটা তো নেই। বারবার দেখলাম, তন্ন তন্ন করে খুঁজলাম। বই, খাতা, সারাটা ব্যাগ উল্টে পাল্টে দেখলাম। ওদের বললাম, কি হবে এবার!

অ্যাডমিট কার্ড ছাড়া পরীক্ষা দেওয়া হবে না। বিকেল গড়িয়ে গেছে। আমি বললাম, আমি তাহলে যাই বাড়ি। চেষ্টা করি বাড়ি গিয়ে অ্যাডমিট কার্ড নিয়ে আসি। কিন্তু সময় তো নেই। রমেশ বললো, ওরা আমার জন্য বাস স্ট্যান্ডে অপেক্ষা করবে। উঠলাম বাসে। বালুরঘাট থেকে রামপুর যেতে সময় লাগলো এক ঘন্টা। রামপুর থেকে দিলাম ছুট। ছুটছি তো ছুটছি। রাস্তা আর শেষ হয় না। হাত পা যেনো ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে আসছে।

শীতের বিকেল। রোদ ক্রমশ তার শক্তি হারিয়ে ফেলছে। পড়িমরি করে বাড়ি এলাম। অ্যাডমিট কার্ডটা নিলাম। তারপর আবার দিলাম ছুট। রাস্তা তো অনেকটা। সাত কিমি। দৌড়, দৌড়, আর দৌড়।পৌঁছলাম রামপুর। বাসে উঠলাম, দেখলাম শীতকালেও সম্পূর্ণ জামা ঘামে ভিজে গেছে। বালুরঘাট বাস স্ট্যান্ডে গিয়ে যখন পৌঁছলাম, তখন সন্ধ্যা পার হয়ে গেছে। রমেশ, সত্যেন আমার জন্য অপেক্ষা করছে।

আজ সত্যেন আর নেই। দেখা হয়নি রমেশের সাথে বহু বছর। আজও এমন অনেক রাতে স্বপ্ন দেখি আমি ছুটছি আর ছুটছি। কিছুতেই আমার গন্তব্যস্থানে পৌঁছতেই পারছি না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *