বাঙালির দশে কার্যহানি! খড়দহে নাট্যচর্চার প্রেরণা ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ

(খড়দার ভূমিপুত্র কৃষিবিজ্ঞানী ড. কল্যাণ চক্রবর্তী খড়দায় একাদিক্রমে ৩৫ বছর অবস্থান করেছেন। তার সঙ্গে খড়দার মানুষের দীর্ঘ সাংস্কৃতিক-সাহিত্যিক-সামাজিক যোগসূত্র আজও বিনষ্ট হয়নি। তিনি আপন-চারণায় সমকালীন সময়ের অভিজ্ঞতা শেয়ার করছেন, তার মধ্যে সেই সময়ের স্থানীয় ইতিহাস কিছুটা ফুটে উঠবে এই আশায় তা পরিবেশিত হল। প্রস্তুত প্রতিবেদনটি তার ১০ম এবং শেষ পর্ব)

ড. কল্যাণ চক্রবর্তী

আমাদের ভারত, ২৭ ডিসেম্বর: খড়দহ-রহড়া নাট্যচর্চার অন্যতম পীঠস্থান বলে আমরা জানি। এটাও জানি রহড়া রামকৃষ্ণ মিশনের প্রথম কর্মাধ্যক্ষ স্বামী পুণ্যানন্দ বিগত শতাব্দীর চারের দশক থেকে বালকাশ্রমে নাট্যচর্চা শুরু করেছিলেন, যা রহড়া-খড়দার নাট্যচর্চাকে রসসিক্ত করেছিল। পৌরাণিক ও ঐতিহাসিক নাট্যচর্চার প্রতি পুণ্যানন্দজীর বিশেষ অনুরাগ ছিল। কিন্তু এটা অনেকের অজানা যে, এসবের পশ্চাতে খড়দহের যে মানুষটির প্রভাব সবচেয়ে বেশি ছিল, তিনি হলেন খড়দহেরই সন্তান শ্রী ক্ষীরোদপ্রসাদ ভট্টাচার্য, পরবর্তী কালে ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ।

তিনি শ্রীসারদা মায়ের নিকট মন্ত্র-দীক্ষিত হয়েছিলেন। তিনি শ্রীরামকৃষ্ণ-পার্ষদ স্বামী সারদানন্দের সামীপ্যে-সান্নিধ্যে এসেছিলেন। পেশাদারী রঙ্গমঞ্চে জনমনোরঞ্জনকর পেশাদার নাটক লিখিয়ে হিসাবে তাঁর বিশেষ খ্যাতি ছিল। নাটকের টানে তিনি অধ্যাপনার চাকরি ছেড়েছিলেন, এতটাই ভালোবাসা ছিল।

যে বছর স্বামী বিবেকানন্দের জন্ম হয়, যে বছর নাট্যকার দ্বিজেন্দ্র লাল রায়ের জন্ম, সেই বছরেই অর্থাৎ ১৮৬৩ সালের ১২ ই এপ্রিল এক বৈষ্ণব গুরু-বংশে জন্মগ্রহণ করেন ক্ষীরোদপ্রসাদ। খড়দহের ভট্টাচার্য পাড়ায় তাঁর বসবাস ছিল। পরে অধ্যাপনা ও নাট্যচর্চার কারণে উত্তর কলকাতার বাগবাজার অঞ্চলের বাসিন্দা হয়েছিলেন। ‘খড়দহ-রহড়া — অতীত ও বর্তমান’ গ্রন্থের লেখক শ্রী নিখিলরঞ্জন রায় (২০১৩) তাঁর সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে জানাচ্ছেন, “ক্ষীরোদপ্রসাদের ব্যক্তিগত জীবন সম্বন্ধে তেমন কিছু জানা যায় না।” খড়দহে তাঁর স্মরণ-মনন ও গবেষণা সেইরকম গভীরভাবে করা হয়েছে, এমনটি মনে হয় না। একটি মূর্তি বসিয়ে, একটি মঞ্চের নামকরণের মধ্যে দিয়ে কোনো মনীষীচর্চা যথার্থভাবে সম্পন্ন হয় না। তাঁর নাটকের নিবিড় পাঠ ও আলোচনা, তাঁর মনন অনুভব, বিষয় সমীক্ষা, দেশভক্তি, পুরাণের প্রতি আগ্রহ ইত্যাদি বিষয়ে চর্চা না করলে, তা কেবল লোকদেখানো উদ্যোগ মনে হবে। খড়দায় এমন নাট্যকার কে আছেন, বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবেন, তাঁর অধিকাংশ নাটক পড়েছেন! তাঁর লেখা ‘রঘুবীর’ (১৯০৩), ‘পদ্মিনী’ (১৯০৬), ‘উলুপী’ (১৯০৬) ইত্যাদি নাটক পড়েছেন, এমন নাট্যমোদী ব্যক্তি কে আছেন?

কেউ কর্মসূত্রে খড়দহ ত্যাগ করলে, খড়দার মানুষ যদি তাকে ভুলে যান, তবে সুবিচার করা হয় না। অথচ খড়দহকে তিনি যে মনে রাখতেন, খড়দহের শ্যামসুন্দরজী যে তাঁঁর মানস নেত্রে সদা উদ্ভাসিত হয়ে থাকতেন, তার খানিকটা আলোচনা করেছেন নিখিলরঞ্জন দে, ‘নরনারায়ণ’ (১৯২৬) নামক তাঁর একটি পৌরাণিক নাটকের প্রসঙ্গ অবতারণা করে।

“কোন্ বেণুতে ব্রজের কানু/বাজিয়েছিলে প্রেমের গান,/কোন্ বেণুতে হাসিয়েছিলে,/কোন্ বেণুতে কাঁদিয়েছিলে,/কোন্ বেণুতে নাআিয়েছিলে/বজ্রবধূর কোমল প্রাণ?”

তাঁর পৌরাণিক নাটকগুলির মধ্যে সাবিত্রী (১৯০২), ভীষ্ম (১৯১৩), বভ্রুবাহন (১৯৯৯) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। স্বদেশপ্রেমিক নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের পরেই তাঁর জায়গা। অথচ খড়দহবাসী তাঁকে সেইভাবে মনে রাখেনি। তার কারণ হতে পারে, তিনি কর্মজীবনে খড়দহ ছেড়ে উত্তর কলকাতায় চলে গিয়েছিলেন, শেষ জীবনে গিয়েছিলেন বাঁকুড়ার অদূরে বিকনা গ্রামে। চোখের বাইরে গেলে, মনের বাইরেও চলে যান যেন! বাঁকুড়ার পল্লী প্রকৃতির বুকে গৃহ নির্মাণ করে তিনি বসবাস করতে লাগলেন। ১৯২৭ সালের ৪ঠা জুলাই সেখানেই প্রয়াত হলেন। দ্বিতীয়ত তাঁর প্রবণতা ছিল মূলত পৌরাণিক নাটকের উপর, যেখানে দেবদেবীর মাহাত্ম্য কীর্তন যথেষ্ট পরিমাণে উজ্জ্বল, তা বামপন্থী গণনাট্য সংস্থার কর্মীদের কাছে বিশেষ দাগ কাটার নয়, দাগ কাটেওনি। তাঁর ‘বঙ্গের প্রতাপাদিত্য’ নাটকে মোঘল শক্তির বিরুদ্ধে প্রতাপাদিত্যের লড়াইয়ের মধ্যেকার সংকেত ও নাট্য-আবহ সকল বঙ্গভাষী হয়তো সেইসময় অন্তরে গ্রহণ করেননি। ইদানীং দেখা যাচ্ছে নতুনভাবে প্রতাপাদিত্য বাঙালি মানসের অন্যতম চরিত্ররূপে উদ্ভাসিত হয়ে উঠছেন।

এদিকে ক্ষীরোদপ্রসাদের সব নাটক ছাড়িয়ে আরব্য রজনীর ‘আলিবাবা’-র মতো চটুল, হালকা চালের নাটক সবচাইতে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। এই কেন-র উত্তর বাঙালি আগামী দিনে হয়তো খুঁজবেন আরও গভীরভাবে। তিনি বাংলার বিপ্লব আন্দোলনকে প্রভাবিত করতে লিখলেন ঐতিহাসিক নাটক ‘বঙ্গের প্রতাপাদিত্য’ (১৯০৩)। জাতীয়মন্ত্রপূত অনুপ্রাণনাময় এই নাটকে ভুঁইয়া প্রতাপাদিত্যকে মোঘলদের বিপ্রতীপে এক প্রবল প্রতাপান্বিত দেশপ্রেমিক, স্বাধীনতাকামী রূপে তুলে ধরেছেন তিনি। বাঙালিকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করেছেন। সেনাদের উদ্দেশ্যে প্রতাপের বক্তব্য, “ভাই সব! তোমরা সবাই মিলে মা যশোরেশ্বরীর যশোরের সীমা বৃদ্ধি করো।” বাঙালির একতা বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তার কথাও নাট্যকার প্রকারান্তরে বুঝিয়ে দিয়েছেন। বাঙালির বিশ্বাসঘাতকতায় প্রতাপাদিত্য মোঘল সেনার হাতে পরাজিত হয়েছিলেন।

সেলিম বা জাহাঙ্গীরকে বাঙালি সম্পর্কে মন্তব্য করতে দেখা যায়, “বাঙালিতে একতা নেই, বাঙালিতে সত্যনিষ্ঠার অভাব, বাঙালি পরছিদ্রান্বেষী, পরশ্রীকাতর, স্বার্থপর। একা বাঙালি মহাশক্তি — জ্ঞানে, বিদ্যায়, বুদ্ধিমত্তায়, বাকপটুতায়, কার্যতৎপরতায় বাঙালি জগতে অদ্বিতীয়, মহাশক্তিমান সম্রাটেরও পূজনীয়। কিন্তু একত্রে দশ বাঙালি অতি তুচ্ছ — হীন হতেও হীন। অন্য জাতির দশে কার্য, বাঙালির দশে কার্যহানি..।” –সমাপ্ত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *