রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের বরিষ্ঠ প্রচারক কেশবরাও দীক্ষিত আজ পরলোক গমন করলেন

শ্রী কেশবরাও দত্তাত্রেয় দীক্ষিত (১৯২৫-২০২২) দেশসেবার সূত্রে এক মারাঠি যুবকের বাঙ্গালি হয়ে ওঠার গল্প।

ড. কল্যাণ চক্রবর্তী
আমাদের ভারত, ২০ সেপ্টেম্বর:
১৯৫০ সাল থেকে একাদিক্রমে প্রায় ৭২ বছর কাটিয়েছেন এক মারাঠি যুবক, বঙ্গের নগরে প্রান্তরে, জাতীয়তাবাদ, দেশপ্রেম, ভারতীয় সংস্কৃতির অখণ্ড চর্চায় বাঙালি সমাজকে অবগাহনের মন্ত্র শোনাতে গিয়ে নিজে কখন যে অনবধানে ডুব দিয়েছেন বঙ্গ-সংস্কৃতির অতল গভীরে, আর হয়ে উঠেছেন আদ্যন্ত এক বাঙালি– তা নিজেও হয়তো টের পাননি। হ্যাঁ, এমনই এক বরিষ্ঠ দেশ-সেবক আজও আমাদের সঙ্গে একই সংস্কৃতিচর্চার শরিক হয়ে, দীর্ঘকাল বাঙলার পুণ্যভূমে দেশভক্তির জপ-মালার পুঁথি বিতরণ করেছেন। তিনি সর্বজনমান্য শ্রী কেশবরাও দীক্ষিত।

সেই প্রবাদ প্রতিম পুরুষ কেশব রাও দীক্ষিত আজ পরলোক গমন করলেন। আমাদের সকলের অতি প্রিয়, সবার আপনজন ও প্রেরণা পুরুষ মাননীয় শ্রী কেশবরাও দীক্ষিত আজ ২০ই সেপ্টেম্বর ২০২২, মঙ্গলবার কলকাতায় অ্যাপোলো হাসপাতালে সকাল 10:34 মিনিটে আমাদের ছেড়ে মৃত্যুলোক থেকে অমৃতলোক গমন করেছেন। মৃত্যু সময় তার বয়স হয়েছিল ৯৮ বছর।

পশ্চিমবঙ্গে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের কাজের শুরুর সময় থেকে নিজেকে সম্পূর্ণ সমর্পণ করে অসংখ্য হিন্দু সৈনিকের মনে প্রেরণার সঞ্চার করে গত হলেন এই মহাপুরুষ। আমাদের মনের মধ্যে সর্বদা অমর হয়ে থাকবেন আমাদের প্রিয় কেশবজী।

শ্রী কেশবরাও দীক্ষিতের জন্ম ১ লা আগষ্ট, ১৯২৫ সালে মহারাষ্ট্রের ওয়ার্ধা জেলার পুলগাঁও গ্রামে। পিতা দত্তাত্রেয় দীক্ষিত, মাতা সগুণা দেবী এবং পিতামহ চিন্তামণি দীক্ষিত। পারিবারিক পেশা পৌরোহিত্য হলেও, তাঁর পিতা ছিলেন পরিবারের প্রথম চাকুরীজীবী। দত্তাত্রেয় একটি কটন মিলে কাজ করতেন। পাঁচ ভাই ও চার বোনের সংসারে কেশবজী ছিলেন দ্বিতীয় সন্তান। ১৯৩৯ সালের ডিসেম্বর মাসে তাঁর উপনয়ন দেওয়া হল। ১৯৪৯ সালে জলগাঁও-এর এম. জে. কলেজ থেকে তিনি মারাঠি ও সংস্কৃতে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করলেন। ১৯৫০ সাল থেকে শুরু হয় প্রচারকের জীবন।

রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের সূচনা আর কেশবজীর জন্মসাল ঘটনাচক্রে একই বছর। আর এই দুই ‘কেশব’ সান্নিধ্য যেন দীপ জ্বালানোর এক ক্রমান্বয় বার্তা। কেশব বলিরাম হেডগাওয়ার কিশোর কেশবের প্রাণে যে অগ্নি প্রজ্বলন করেছিলেন তা নানান শাখায় বঙ্গভূমিতে শতদীপে বিকশিত হয়েছে। কিশোরবেলায় কেশবজী রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের প্রতিষ্ঠাতা ডা. হেডগেওয়ারের সান্নিধ্যে আসেন, তখন তাঁর বয়স বারো বছর। ডাক্তারজী ফুলগাঁও জংশন ষ্টেশন হয়ে ওয়ার্ধা জেলারই আর্ভি শহরে যেতেন, সেখানে সঙ্ঘের একটি ভালো শাখা ছিল, ৪০-৪৫ জন দেশব্রতী মারাঠি যুবক রোজ আসতেন সেখানে। এমনই একটি শাখায় ডাক্তারজীও মাঝেমাঝে আসতেন; নামতেন ফুলগাঁও জংশনে এবং সেই সুযোগে কেশবজীর পিতা ডাক্তারজীকে তাদের বাড়িতে আমন্ত্রণ জানাতে ভুলতেন না কারণ কেশবজীর বাবাও একজন স্বয়ংসেবক ছিলেন। দত্তাত্রেয়র আন্তরিকতায় মুগ্ধ হয়ে ডাক্তারজী তাদের বাড়িতে একাধিকবার এসেছেন, চা-জলখাবার খেয়েছেন। এমনই আসা-যাওয়ার সূত্রে বালক কেশব প্রথমবার ডাক্তারজীকে নিজের বাড়িতে দেখলেন ১৯৩৭ সালে।

দরজার কোণে দাঁড়িয়ে নিরীক্ষণ করতে লাগলেন এক মহাপুরুষকে, তাঁর কথা গোগ্রাসে গিলতে লাগলেন এক অমোঘ আকর্ষণে। ডাক্তারজী জলখাবার খাচ্ছেন, ডাকলেন বালক কেশবকে। “অ্যাই তোমার নাম কী?” “আমি কেশব।” “বেশ বেশ! এই ছেলেটাকে আমাকে দিয়ে দিন।” দত্তাত্রেয় বললেন, “আপনার-ই তো ছেলে, নিয়ে যান।” খুব হাসিঠাট্টা করছেন ডাক্তারজী।

১৯৩৮ সালের কোনো একদিন ফুলগাঁও থেকে ৩-৪ কিলোমিটার দূরে নাসেরগাঁও সঙ্ঘ-শাখায় কেশবজীর জন্য অপেক্ষা করছিল এক সুবর্ণ দিন। সেদিন ডাক্তারজী শাখায় এলেন। শাখায় উপস্থিতির সংখ্যাও সেদিন যথেষ্ট। সভায় প্রার্থনায় তন্ময় হয়ে গাইলেন কিশোর কেশব। মারাঠি ও হিন্দীতে শ্লোগানও দিলেন তিনি। সভায় উপস্থিত ছিলেন কেশবের পিতা দত্তাত্রেয়। ডাক্তারজী বালকের কণ্ঠে সঙ্ঘগীত শুনে অত্যন্ত আনন্দিত হলেন, খুব আদর করলেন বালক কেশবকে। ওই সোনালি দিনগুলি স্মরণ করার সময় সপ্রতিভ হয়ে উঠতেন কেশবজী, ফিরে যেতেন সেই বালক-বেলায়।

গভীর দুঃখ ও বেদনার বিষয় আজ ২০ শে সেপ্টেম্বর, ২০২২ সকাল ১০ টা ৩৪ মিনিটে ইহলোক ছেড়ে অমৃতলোকে পাড়ি দিয়েছেন তিনি। সেই সঙ্গে একটি ঐতিহাসিক যুগের অবসান হল, যার ছত্রে ছত্রে ছিল সনাতনী সন্দেশ, সৌকর্য এবং অভূতপূর্ব স্নেহ ভালোবাসা। পরম শ্রদ্ধেয় কেশবজীকে বঙ্গমাতা তাঁর নিজের সন্তান করে নিয়েছিলেন। আমরা আজ এক গর্বিত ভারতবাসী তথা বিশিষ্ট বাঙালিকে হারালাম। তিনি আদ্যন্ত বাঙালি হয়ে আমাদের সকলের অভিভাবক হয়ে উঠেছিলেন। সেই ছাতা আজ সরে গেলো। কিন্তু তিনি আমাদের নিশ্চয়ই আশীর্বাদ করবেন, যেখানেই থাকুন। ওনার আত্মার চিরশান্তি কামনা করছি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *