শিকড়ের টানে ময়মনসিংহের প্রাক্তনীরা

অশোক সেনগুপ্ত
আমাদের ভারত, ১৪ সেপ্টেম্বর: কলকাতা থেকে দিল্লির দূরত্ব ১৫৩৫ কিলোমিটারের মত। সড়কপথে সময় লাগার কথা ২৮ ঘন্টার মত। এ শহর থেকে হরেক কাজে অহরহ লোকে উড়ে যাচ্ছেন দিল্লিতে। যেন কোনও দূরত্বই নয়। অথচ, দিল্লির চেয়ে ঢের কাছে হয়েও যেন কত দূরের শহর ময়মনসিংহ। হিসেবের নিক্তিতে ৪৪৫ কিলোমিটারের মত। যশোর রোড ধরে গেলে সময় লাগার কথা ১২ ঘন্টার মত। কিন্তু মাঝের কাঁটাতার সেই দূরত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ।

দেশভাগের প্রায় ৭৫ বছর পরেও সাবেক পূর্ববঙ্গের সাংস্কৃতিক রাজধানী ময়মনসিংহের স্মৃতি আঁকড়ে আছেন পশ্চিমবঙ্গের অগণিত লোক। এখনও ওঁদের অনেকেই চোখ বুঁজলে দেখতে পান সেই ‘জননী বঙ্গভূমি’কে। পূর্বপুরুষদের যে ভিটে ছেড়ে একরাশ অনিশ্চয়তা নিয়ে যাঁদের চলে আসতে হয়েছিল এই বাংলায়।

একটু দূরেই মাঠে কালো মেঘের মত ধান হয়েছে-
লক্ষীবিলাস ধান- সোনা রঙ ধরবে ব’লে। আরো দূরে ছলছলাৎ পাগলী নদীর ঢেউ। তার উপর চলেছে ভেসে পালতোলা ডিঙি ময়ূরপঙ্খি। সব ফেলে ওঁরা মাঝে মাঝে মানসিকভাবে ফিরে যেতে চান শিকড়ের টানে। সেই লক্ষ্যে তৈরি তাঁদের মোর্চা ‘ময়মনসিংহ প্রাক্তনী’ পায়ে পায়ে ২৫ বছরে পা দিল।

ময়মনসিংহ ছিল পূর্ববঙ্গের সাংস্কৃতিক নগরী বিখ্যাত  সেতারবাদক বিলায়েত খাঁ (৮ আগস্ট, ১৯২৮ – ১৩ মার্চ, ২০০৪) থেকে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় (জন্ম: ২ নভেম্বর, ১৯৩৫), বিশিষ্ট বাংলা সাহিত্য ও লোকসংস্কৃতি গবেষক ও অধ্যাপক আশুতোষ ভট্টাচার্য (১৯০৯ – ১৯ মার্চ, ১৯৮৪) -থেকে তসলিমা নাসরিন (জন্ম: ২৫ আগস্ট, ১৯৬২) — বিভিন্ন পেশায় ময়মনসিংহের প্রাক্তনী গুণী মানুষের নাম-তালিকা অতি দীর্ঘ। স্বাধীনতা সংগ্রামেও ময়মনসিংহ ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জায়গায়। সুরেন্দ্রমোহন ঘোষ (২২ এপ্রিল, ১৮৯৩ – ৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৬), ভূপেন্দ্রকিশোর রক্ষিত রায় (১৯ মার্চ, ১৯০২ – ২৪ এপ্রিল, ১৯৭২), মতিলাল পুরকায়স্থ (বিংশ শতক), প্রতুল ভট্টাচার্য (১৬ জানুয়ারি ১৯০০ – ২৯ আগস্ট, ১৯৭৮) , হরসুন্দর চক্রবর্তী (১৯০৫ – ২১ মে, ১৯৭৩)— এই তালিকাও অত্যন্ত দীর্ঘ। ছিলেন রাজা জগৎ কিশোর আচার্য চৌধুরী (১২৬৯ – ২২ চৈত্র, ১৩৪৫) – মুক্তাগাছার জমিদার, তাঁর দানশীলতা ছিল রূপকথার মত কিংবদন্তীতুল্য।

১ মে ১৭৮৭ খ্রিস্টাব্দে ময়মনসিংহ জেলা গঠিত হয়। ১৭৯১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সেহড়া মৌজায় নাসিরাবাদ নাম দিয়ে জেলা শহরের পত্তন হয়। শহর স্থাপিত হওয়ার পর ৮ই এপ্রিল ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে পৌরসভা গঠিত হয় নাসিরবাদ মিউনিসিপ্যালিটি। বঙ্গদেশে এটি প্রথম এবং উপমহাদেশে এটি ছিল দ্বিতীয় পৌরসভা। প্রথম নন অফিশিয়াল চেয়ারম্যান ছিলেন চন্দ্রকান্ত ঘোষ। কালেক্টরেট ভবন ছিল ময়মনসিংহ শহরের কেন্দ্রবিন্দু। এ সব তথ্য আজ প্রায় বিলীন হয়ে যেতে বসেছে ইতিহাসের গহ্বরে।

‘ময়মনসিংহ প্রাক্তনী’-র তরফে দেবব্রত গোস্বামী এই প্রতিবেদককে জানান, আমাদের সভাপতি ড.বিকাশ চন্দ্র সান্যাল, সাধারণ সম্পাদক তপন কুমার রায়। মুখ্য উপদেষ্টা দীনেন্দ্রকুমার গোস্বামী (৯১) ছাড়াও সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা তিন সদস্য এখনও আছেন আমাদের মধ্যে। তাঁরা হলেন বিনয় ভট্টাচার্য (৯১), নিরঞ্জন রায় (৮৪), দেবব্রত গোস্বামী (৭৫) ও প্রাক্তন সভাপতি ডা: সুগত মোহন বসু (৬৭)। প্রতি বছর আমরা মিলিত হই একসঙ্গে। সদস্য প্রায় ৮০০। এর মধ্যে ৩০% মহিলা সদস্য। শিলিগুড়ির শাখা সদস্য সংখ্যা প্রায় ৩০০।

বিশিষ্ট ব্যক্তিদের অনেকেই আছেন ‘ময়মনসিংহ প্রাক্তনী’-তে। প্রথমেই যাঁদের নাম মনে আসে তাঁরা হলেন শিল্পী অজয় চক্রবর্তী, পি সি সরকার (জুনিয়র), অলকানন্দা রায়, ড.মহুয়া মুখোপাধ্যায়, প্রসাদ রঞ্জন রায়, মমতা শংকর ও চন্দ্রোদয় ঘোষ, আমাদের প্রাক্তনীর চেয়ারম্যান ও বিখ্যাত শিল্পপতি কুণাল রায়চৌধুরী। এই তথ্য জানিয়ে দেবব্রত গোস্বামী বলেন, সংগঠনের ৮০%ই প্রবীণ। এঁদেরও অনেকে আবার অতি প্রবীন। ৬০ বছরের নীচে প্রায় ২০%।

আবার একঝলক ফিরে আসি ময়মনসিংহের অতীতের কথায়। ১৭৮৭ খ্রিস্টাব্দে সেখানে সরকারী ডাক ব্যবস্থার প্রচলন করা হয়। ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে জেলা বোর্ড গঠন করা হয়। প্রথম সরকারি চিকিৎসা কেন্দ্র চালু করা হয় ১৭৯১ খ্রিস্টাব্দে। ময়মনসিংহ শহর থেকে প্রথম মুদ্রিত পুস্তক প্রকাশিত হয় ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে। ১৮৪৬ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয় প্রথম ইংরেজি স্কুল। ময়মনসিংহ জিলা স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয় ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে। জেলার প্রথম আদম শুমারী পরিচালিত হয় ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে। টেলিগ্রাফ অফিস স্থাপন ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে।। ঢাকা-ময়মনসিংহ রেলপথ চালু ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দে, এবং ময়মনসিংহ-জগন্নাথগঞ্জ রেলপথ চালু হয় ১৮৬৫ সনে। ১৯০৫ সালে নাসিরবাদ নাম বদলে ময়মনসিংহ পৌরসভা নামকরণ হয়। ১৯১০ সালে পৌরসভার একতলা পাকা ভবন নির্মাণ হয় যেটি এখনও ব্যবহৃত হচ্ছে।

‘ময়মনসিংহ প্রাক্তনী’-র ২৫ বছর উপলক্ষে সম্প্রতি
গোলপার্কের রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অব কালচারের শিবানন্দ হলে প্রদীপ জ্বালিয়ে অনুষ্ঠানের সূচনা করেন স্বামী সুপর্ণানন্দ। স্তোত্র পাঠ করেন পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী। বাংলাদেশের উপ হাইকমিশনার তৌফিক হাসান সহ অনেক বিশিষ্টজন উপস্থিত ছিলেন। স্মৃতিচারণায় তাঁদের অনেকেই শিকড়ের টানে কয়েক মুহূর্তের জন্য অতীতকে আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করেন। সঙ্গীত পরিবেশন করেন ডাঃ জগদীন্দ্র মণ্ডল ও পণ্ডিত অমিতাভ মুখোপাধ্যায়। উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে দেবব্রত গোস্বামী জানান, ‘সারা বছর ধরে নানা অনুষ্ঠান ও প্রতিযোগিতা চলবে।’

আরও পড়ুন
বিস্মৃতির আড়ালে ময়মনসিংহের রত্ন, উদ্যোগপতি হেমেন্দ্রমোহন বসু

ইচ্ছে থাকলেও অতিমারীর এই আবহে ধুমধাম করে
রজত জয়ন্তী উৎসব পালনের অবকাশ খুব একটা নেই। দেবব্রতবাবু জানান, তা সত্বেও অনলাইন/অফলাইনে ময়মনসিংহের উপর বিভিন্ন বয়সভিত্তিক রচনা প্রতিযোগিতা, নৃত্য ও সংগীত, অংকন এবং বিতর্ক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হবে। ফেসবুকের পেজে প্রকাশ করা হবে বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠানের বিজ্ঞপ্তি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *